প্রাচীন ভারতীয় নাটক ও তার প্রকৃতির পরিচয় দিন।

থিয়েটার বলুন বা নাটক অথবা যাত্রা- মঞ্চ হল তার অপরিহার্য অঙ্গ। যদিও মঞ্চ ছাড়া উন্মুক্ত স্থলে ‘পথ নাটিকা’ হয়। কিন্তু মঞ্চ হল মঞ্চ, তার গরিমাই আলাদা। আর এই মঞ্চেরও প্রকারভেদ আছে, যা শুনলে আপনারা আশ্চর্য হয়ে যাবেন। ধরুন যাত্রার মঞ্চ- যা কিনা তিন দিক খোলা হয়। আবার থিয়েটারের স্থায়ী মঞ্চ শুধু সামনের দিক খোলা, ডাইনে বাঁয়ে দু’দিকে থাকে দুটি উইংস। পিছনে চলতে থাকে কাপড়ের ছবি আঁকা পট পরিবর্তন। আবার রবীন্দ্র নাটকের ক্ষেত্রে পিছনে কোন ছবি থাকে না, থাকে শুধু একটি সাদা কাপড়। আর্ট ডিরেক্টররা আবার নানা ভাবে থিয়েটারের সময় মঞ্চ সাজান। মঞ্চের কি বাহার। ‘কিন্তু একেবারে প্রচীনকালেও কি আজকের মত এরকম মঞ্চ ছিল? নাটকের উৎপত্তিই বা হল কি করে?’- প্রশ্নগুলো মনে উঁকি দিতেই পারে। চলুন দেখে নেওয়া যাক প্রাচীনকালে কি রকম মঞ্চ হত এবং নাটকের উৎপত্তিই বা হল কি ভাবে।

পাশ্চাত্য মতে ‘মঞ্চ’ বা ‘স্টেজ’-এর সংজ্ঞা এরকম- ‘যে জায়গায় অভিনেতারা সাধারণত অভিনয় করেন তাকে মঞ্চ বলে। ঐতিহ্যবাহী প্রেক্ষাগৃহগুলিতে মঞ্চ হত ঘরের মত। যার মধ্যে একটি দেওয়াল সরিয়ে ফেলা হয়েছে দর্শকদের অভিনয় দেখবার জন্য। বাইরের অংশটা দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত।’ (A Dictionary of Literary Terms- Martin Gray/ P-197) [The space in which actors perform. In traditional theaters the stage is an area like room, of which one of the walls has been removed, allowing the audience to see the action there. An apron stage just out towards the audience.]

পাশ্চাত্য মতে ‘স্টেজ’ (stage) শব্দটি লাতিন ভাষার ‘স্টেয়ার'(stare) শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ হল ‘দাঁড়িয়ে থাকা’।

খ্রীষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে বহরতার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘নাট্যশাস্ত্র’-এ আমরা প্রাচীন ভারতের শিল্পকলা ও নাটকের মঞ্চের বিস্তৃত বর্ণনা পাই। তবে ‘নাট্যশাস্ত্র’-এর আগে খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম বা চতুর্থ শতাব্দীতে পানিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’ গ্রন্থে আমরা মঞ্চের উল্লেখ পাই। এছাড়াও পতঞ্জলির ‘মহাভাস্য'(খ্রী:পূ: ২য় শতক) গ্রন্থে ‘সৌভানিক’, ‘গ্রান্থিক’, ‘ব্যায়ামাস্রাক’ ইত্যাদি শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘সৌভানিক’ শব্দের অর্থ ‘নাট্যকার’। ‘গ্রান্থিক’, ‘সূত্রধর’, ‘ব্যায়ামাস্রাক’ হল সহ-অভিনেতা।

আসল কথাটি নাট্যাচার্য ভরত মুনির ব্যাখায় পাওয়া যায় যে কালিদাস ও ভাসের আগেও ‘রঙ্গালয়'(মঞ্চ) বিদ্যমান ছিল। মঞ্চের পরিকাঠামো সুপরিকল্পিত ও সুন্দর ভাবে নির্মাণ করা হত।

তাঁর ‘নাট্যশাস্ত্র’ গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে নাট্যাচার্য ভরত উল্লেখ করেছেন যে কারিগরি বিষয়ে পারদর্শী দেবতা বিশ্বকর্মা স্বয়ং নাট্য মঞ্চকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন- (১) আয়তক্ষেত্রকার (বিক্রিস্তা) (২) বর্গক্ষেত্রকার (চাতুয়াশ্রা) (৩) ত্রিভূজাকার (ত্রায়াস্রা)

আয়তন অনুযায়ী আবার মঞ্চকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে- (ক) বৃহৎ (জেস্তা) (খ) মাঝারি (মধ্যা) (গ) ছোট (আবর বা কানিয়াস)

আচার্য ভরতের ‘বিক্রিস্তা’কে প্রাধান্য দিলে মঞ্চ অবশ্যই আয়তাকার ও বিস্তৃত হওয়া উচিত। এটি আবার দু’টি সমান বর্গাকারে ভাগ হত। সামনের দর্শকদের জন্য নির্দিষ্ট অঞ্চলটিকে বলা হত ‘রঙ্গমন্ডল’। পিছনের অংশটি ১৬টির মধ্যে দু’টি অংশে বিভক্ত করা হত। পিছনের অংশের সামনের দিকটা আবার দ’ভাগে ভাগ করা হত (৮x৩২)। পিছনের কেন্দ্রস্থ অংশ আবার ৮x৮ বর্গাকারে ভাগ করা হত। একে বলা হত ‘রঙ্গশীর্ষ’। আর পূর্ববর্তী অংশের মধ্যবর্তী বর্গাকার অংশটিকে বলা হত ‘মঞ্চ’ বা ‘রঙ্গপীঠ’। মঞ্চের দু’পাশে দু’টি দরজা থাকত। সমতল ভূমিতে মঞ্চটি তৈরী হত, ডিম্বাকৃতি বা উঁচু-নিচু জমিতে করা হত না। বিভিন্ন রঙের স্তম্ভের পাশে বিভিন্ন বর্ণের দর্শকদের বসার স্থান হত। সাদা স্তম্ভটি বাহ্মণদের আসন নির্দেশ করত। লাল রঙের স্তম্ভ নির্দিষ্ট করত ক্ষত্রিয়দের আসন।উত্তর-পশ্চিমে হলুদ স্তম্ভটি বৈশ্যদের আসন এবং উত্তর-পূর্ব দিকে নীল স্তম্ভটি সংরক্ষিত ছিল শূদ্রদের আসনরূপে।

সেখানে তিনি বর্ণনা করেছেন মঞ্চের দেওয়ালের সাজসজ্জা, ধ্বনি নির্গমন ব্যবস্থার (sound system) ব্যবহার, মঞ্চের আকৃতি ইত্যাদি। ‘পেকাটি’, ‘আপাতি’, ‘প্রতিশিরা’, ‘যবনিকা’ নামক পর্দাগুলো ব্যবহার করা হত মঞ্চে।

বিশিষ্ট লেখক কৌশিক স্যানাল তাঁর ‘রঙ্গমঞ্চ স্থাপত্য’ গ্রন্থে প্রাচীন থিয়েটারের উৎপত্তি সম্বন্ধে বলতে গিয়ে লিখেছেন, “ঋকবেদের কথোপকথন, পুরাণের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানই ছিল প্রাচীন থিয়েটারের অনুপ্রেরণা এবং মূল শিকড়। সুতরাং, ভারতীয় থিয়েটারের উদ্ভব বেদ ও পুরাণ থেকে। পরে এটি ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছিল মহাকাব্যগুলির পথে। কিন্তু পরবর্তীকালে গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে মহাত্মা বিশ্বমিত্র, বিপাশা ও শতদ্রু নদী (ঋকবেদ, ৩য় অধ্যায়, ৩৩ নং শ্লোক), অথবা যম ও তাঁর বোন যমুনার কথোপকথন (ঋকবেদ, দশম অধ্যায়, ১১ নং শ্লোক) থিয়েটারের উৎস হিসাবে যথার্থ বলে গ্রহণ করতে পারি না।”

বিশিষ্ট পন্ডিত আদ্য রঙ্গচার্য বলেছেন, “এই কথোপকথনের দৃশ্যগুলি অবশ্যই ইতিমধ্যে একটি প্রতিষ্ঠিত নাট্য উৎসব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল।” (দি ইন্ডিয়ান থিয়েটার, আদ্য রঙ্গচার্য, পৃ: ৯)

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে নাটকের উৎপত্তি কি থেকে তা নিয়ে পন্ডিত মহলের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও মতভেদ আছে।

“এটা লক্ষণীয় যে ‘নাট্য’ বা ‘নাটক’ শব্দটি এসেছে ‘নাট’ শব্দ থেকে, যা সংস্কৃতের ‘নৃত’ থেকে প্রাকৃতের ‘নাট’ হয়েছে। পানিনি (খ্রী:পূ: ৪র্থ শতাব্দী) এবং পতঞ্জলি (খ্রী:পূ: ২য় শতাব্দী) থেকে জানা যায় যে, শিক্ষিত সমাজ তাদের কথ্য ভাষা হিসাবে সংস্কৃত ভাষাকে ব্যবহার করত আর সাধারণ মানুষ প্রাকৃত ভাষায় কথা বলত। সুতরাং, এটা ধরে নেওয়া যায় যে নাটকের উদ্ভব সাধারণ জনতার অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই হয়েছিল। এরপরে যখন এটি রাজ-রাজড়াদের পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করে, তখন এটি পালিশ হয়ে সংস্কৃত সাহিত্যের স্তরে পৌঁছে যায়। এরপরে এর রীতিনীতি সম্পর্কে এত বিধিনিষেধ অর্পিত হয়েছিল যে যা রূপান্তর করা প্রায় অসম্ভব ছিল।

সুতরাং, আমরা বলতে পারি যে রাজাদের রাজ্যাভিষেক বা বসন্ত উৎসবের আগেও নাটকের উদ্ভব হয়েছিল প্রকৃতির উপাসনার মাধ্যমে, মন্দিরের উঠোনে বা মাঠে অথবা খোলা জায়গায় সাধারণ জনতার নাচ, গান এবং অভিনয়ের মাধ্যমে পূজা-অর্চনার স্থলে।” (দি ইন্ডিয়ান থিয়েটার, আদ্য রঙ্গাচার্য, পৃ:৪)

বিভিন্ন তথ্য ও পণ্ডিতদের রচনা থেকে প্রাপ্ত উদাহরণ থেকে নাটক ও নাট্য-মঞ্চের যে ব্যাখা পাওয়া যায় তা যদিও পরস্পরের পরিপূরক নয় বা যথেষ্ট তথ্য সমৃদ্ধ নয়, তবুও এগুলিকেই মূলত নাট্যমঞ্চ বা নাটকের জন্মলগ্ন হিসাবে ধরা হয়। পরবর্তীকালে যাত্রা, কথকতা, পাঁচালি, কবিগান প্রভৃতি থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে ও বিভিন্ন স্তরে বর্তমানের নাটক ও তার মঞ্চ এসেছে। নবাব সিরাজ উদ দৌল্লা বা বিভিন্ন জমিদারদের উৎসব মজলিসের কবিগান, কথকতা থেকে লেবেদফ (আধুনিক বাংলা নাটকের জনক) পর্যায় অতিক্রম করে ধীরে ধীরে বাংলায় বর্তমান থিয়েটার ও নাট্য মঞ্চে রূপান্তরিত হয়েছে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading