প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলির গুরুত্ব:
প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ত্রে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের গুরুত্ব সর্বাপেক্ষা বেশি। যে বিজ্ঞানের সাহায়ে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে মাটি খনন করে আবিষ্কৃত বস্তু নিদর্শন ও ভূপৃষ্ঠে প্রাপ্ত পুরোনো বস্তু থেকে প্রাচীন মানুষের বাস্তব জীবন সম্পর্কে জানা যায়, তাকে ‘প্রত্নতত্ত্ব’ বলা হয়। ইউরোপীয় প্রত্নতাত্ত্বিক স্যার উইলিয়ম জোদ্দ, জেমস্ প্রিন্দেশ, হ্যামিলটন বুকানন, স্যার জন মার্শাল প্রমুখ এবং ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দয়ারাম সাহানি প্রমুখের নিরলস গবেষণার ফলে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য উল্লসিত হয়ে উঠেছে।
মুদ্রা ও তার গুরুত্ব:
ভারতে প্রাপ্ত প্রাচীনতম মুদ্রাগুলিতে কেবলমাত্র মূর্তি ও প্রতীক চিহ্ন শো যায়। রাজা ছাড়াও অনেক ব্যবসায়ী, বাণিজ্যিক সংস্থা ংস্থা মুদ্রার প্রবর্তন করত। সম্ভবত মুদ্রার যথার্থতা রক্ষার জন্যই তারা নিজের প্রতীক অঙ্কিত করত। ভারতে গ্রিক আক্রমণের পরে মুদ্রার উপর রাজার নাম লেখার পদ্ধতি প্রচলিত হয়। পৰ্ব্বাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে প্রাপ্ত ব্যাকট্রিয় গ্রিক রাজাদের মুদ্রাগুলি থেকে ওই অঞ্চলের পূর্ণ রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে জানা অনুরূপভাবে শক, পার্থিয়ান ও কুষাণদের ইতিহাস রচনায় মুদ্রাই একমাত্র অবলম্বন। এ ছাড়া ময়, যৌধেয় ও পাঞ্চালের মিত্র রাজবংশের ইতিহাস কেবলমাত্র মুদ্রা থেকেই যায়।
স্বর্ণ, রৌপ্য, তায় ও সিদা দিয়ে তৈরি প্রাচীন ভারতের এই মুদ্রাগুলি ইতিহাসের উপাদান হিসেবে লিপির পরই গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী- সাহিত্য থেকে প্রাপ্ত তথ্য মুদ্রা দিয়ে যাচাই করা হয়। (2) মুদ্রা থেকে রাজার নাম, সাল, তারিখ, নির্ভুলভাবে জানা যায়। (3) মুদ্রা থেকে ধাতুশিল্প ও শিল্পকলা সম্পর্কেও অবহিত হওার যায়। ঐ ভারতে প্রাপ্ত প্রচুর রোমান মূদ্রা ভারত-প্রেম বাণিজ্যের সাক্ষ্য বহন করে ③ সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রাগুলি থেকে তাঁর অশ্বমেধ যজ্ঞ, শিকারপ্রিয়তা ও সংগীতানুরাগের কথা জানা যায়। ঐ স্বর্ণমুদ্রায়। । পরিমাণ লক্ষ করে সেই রাজ্যের আর্থিক অবস্থা উন্নতি বা অবনতির আভাস পাওয়া যায়। এইসব কারণে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় মুরার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।
লিপি ও তার গুরুত্ব:
প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলির মধ্যে লিপির গুরুত্ব সর্বাধিক। লিপি বলতে বোঝায় বিভিন্ন সরকারি তথ্য, যেমন শাসনতান্ত্রিক লিপি। এ ছাড়াও রয়েছে ধর্মলিপি, প্রশস্তিবাচক লিপি, দানসূচক লিপি, ব্যক্তিগত লিপি প্রভৃতি, যেগুলি লোহা, সোনা, তামা, ব্রোঞ্জ, ইট, পাথর প্রভৃতির গায়ে খোদাই করে উৎকীর্ণ করা হত। এই লিপিগুলি সাহিত্যে উল্লেখিত বিভিন্ন তথ্যকে প্রতিষ্ঠিত করে। কারণ সাহিত্যে উল্লেখিত কোনো সাল, তারিখ বা লিপির অনুমোদন ছাড়া ইতিহাস মর্যাদা পায় না। লিপিগুলিতে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা, যেমন- সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত প্রভৃতি এবং ব্রাহ্মী, খরোষ্ঠী, গ্রিক, অ্যারামিক প্রভৃতি লিপিমালা বা বর্ণমালার ব্যবহার দেখা যায়; যা তৎকালীন সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের জানতে সাহায্য করে।
সাহিত্যিক উপাদানগুলির মতোই লিপিগুলিকেও দেশি ও বিদেশি এই দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। ভারতের লেখগুলির মধ্যে সম্রাট অশোকের লেখগুলির স্থান প্রথম ও প্রধান। জেমস প্রিন্সেপ অশোকের লেখগুলি পাঠোদ্ধার করেন। এগুলি থেকে সম্রাট অশোকের ধর্মমত ও বিভিন্ন শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থাদি সম্পর্কে জানা যায়। শকরাজা রুদ্রদামনের ‘জুনাগড় লিপি’, সমুদ্রগুপ্তের ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’, গৌতমী পুত্র সাতকর্ণীর ‘নাসিক প্রশস্তি’ প্রভৃতি থেকে ইতিহাসের নানা তথ্যাদি জানা যায়। এ ছাড়া বিদেশি লিপির মধ্যে এশিয়া মাইনরে প্রাপ্ত ‘বোঘাজকই শিলালিপি’, ‘পারস্যের বেহিস্তান’, ‘পার্সেপলিস’ ও ‘নাকশ্-ই-রুস্তম’-এ প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে আর্যদের ভারতে আগমন, ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে পারসিক আধিপত্যের কথা জানা যায়।
ও ‘নাকশ্-ই-রুস্তম’-এ প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে আর্যদের ভারতে আগমন, ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে পারসিক আধিপত্যের কথা জানা যায়।
ইতিহাসের উপাদন হিসেবে লিপির গুরুত্ব অপরিসীম-① লিপি থেকে রাজার নাম, রাজত্বকাল, সন, তারিখ, রাজ্যজয়, ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে জানা যায়। ② লিপি যুগ যুগ ধরে অক্ষত থাকে বলে এগুলির সত্যতা প্রশ্নাতীত। লিপিগুলি থেকে নির্দিষ্ট সময়ের দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের নানা দিক জানা যায়। লিপির খোদাই ও আধার থেকে সমকালীন পাথর ও ধাতুশিল্পের অগ্রগতি-অবনতির কথা জানা যায়। ⑤ বিদেশি লিপিগুলি থেকে বহির্ভারতের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের কথা জানা যায়। তাই সবদিক বিচার করে বলা যায় যে, প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলির মধ্যে লিপি সর্বশ্রেষ্ঠ স্থানের অধিকারী।
স্থাপত্য-ভাষ্কর্য:
প্রাচীন ভারতের নগর, মঠ, মন্দির, দুর্গ, অট্টালিকা, সমাধি, স্তম্ভ, স্মৃতিস্তম্ভ, মৃৎশিল্প ও মৃৎপাত্র প্রাচীন ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে স্বীকৃত। এগুলি থেকে বিশেষ করে সে সময়ের সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও শিল্পকলার বিবর্তন ও অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র পাওয়া যায়। সিন্ধু উপত্যকায় খননকার্য চালিয়ে একটি সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়েছে। হরপ্পা সভ্যতা 3000-1500 খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ভারতে বিরাজ করত। বিহারের সারনাথ, পাটলিপুত্র, নালন্দায় খননকার্যের ফলে বৌদ্ধ ও আর্য সংস্কৃতির নানা নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। তক্ষশীলার খননকার্য থেকে গ্রিক, পল্লব, শক ও কুষাণ যুগের সভ্যতার নির্দশন পাওয়া যায়। মৌর্য যুগের গুহা, গুপ্ত যুগের অজন্তা-ইলোরার গুহাচিত্রাবলি, ভিতরগাঁও ও দেওগড়ের মন্দির এবং দক্ষিণের চোল-চালুক্য-পল্লব রাজাদের স্থাপত্য-ভাস্কর্য ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান।
মূল্যায়ন পরিশেষে বলা যায়, কোনো যুগের বাস্তব পরিস্থিতির প্রকৃত প্রতিফলন একমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু থেকেই পাওয়া যায়। ফলে বর্তমানে সাহিত্যিক উপাদানের পাশাপাশি প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ওপর নির্ভরশীলতা অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে।