প্লেটোর ন্যায়বিচারের তত্ত্ব-
ভুমিকাঃ
প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব পাওয়া যায় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “The Republic”-এ। এটি প্লেটোর ন্যায়ধর্ম তত্ত্ব বা শুধু ন্যায়তত্ত্ব নামেও পরিচিত। প্লেটো পূর্বোক্ত সকল মতবাদের বিরোধিতা করে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলেছেন যে, “ন্যায়ধর্ম কোন চুক্তি বা প্রথার ফল নয়, বরং এটা মানুষের যাতনা থেকে উদ্ভূত এবং অন্তর্মুখী”। তিনি আরও বলেছেন যে, মেষপালকের ধর্ম যেমন মেষপালের যত্ন নেওয়া, চিকিৎসকের ধর্ম যেমন রোগীকে রোগমুক্ত করা, তেমনি ন্যায়ধর্ম শাসকের ধর্ম শাসিতের কল্যাণ বিধান করা।
প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব আলোচনাঃ
প্লেটোর ন্যায়বিচার ধারণা বাহ্যিক বা কৃত্রিম কিছু নয় তা মানব প্রকৃতির মধ্যে নিহিত মানবাত্মারই স্বরূপ। তাঁর মতে, ন্যায়বিচারের ধারণা ও আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা পরস্পর ঘনিষ্ঠ ও একের ভিতর দুই। বস্তুত ন্যায়বিচার অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের জীবনে কোন প্রভেদ দেখতে পান নি। ব্যক্তি জীবনে যা ন্যায়বিচার রাষ্ট্রীয় জীবনেও তা ন্যায়বিচার।
প্লেটোর মতে, ন্যায়বিচার এমন একটি গুণ যা অন্যান্য গুণ বা প্রজ্ঞা, সাহস ও মিথ্যাচার ইত্যাদি বাদ দিলেও আদর্শ রাষ্ট্রে বিরাজ করে। আদর্শ রাষ্ট্রের বিভিন্ন শ্রেণী যখন তাদের নিজস্ব দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করবে এবং একে অপরের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না তখনই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।
কোন ব্যক্তির জীবনে বিভিন্ন উপাদানের সুষ্ঠু সমন্বয় ও সঠিক বিন্যাসের নাম যদি ন্যায়বিচার হয় তাহলে রাষ্ট্রীয় জীবনেও তাই হবে। অর্থাৎ, ন্যায়বিচার রাষ্ট্রীয় জীবনেও প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যাবে। এর মাধ্যমে দার্শনিক, যোদ্ধা, উৎপাদক শ্রেণী তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী নিজ নিজ কাজে নিয়োজিত থেকে রাষ্ট্রীয় ঐক্য রক্ষা করবে।
সংক্ষেপ প্লেটোর ন্যায়বিচার বলতে বুঝায় যে, অপরের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না কর স্বীয় কাজে নিমগ্ন হওয়ার ইচ্ছা। অর্থাৎ, যে ব্যক্তি শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে যে কাজ করতে আগ্রহী তাকে সে করতে দেওয়ার মধ্যেই ন্যায়বিচার নিহিত।
প্লেটোর ন্যায়বিচারের বৈশিষ্ট্য
প্লেটোর ন্যায়বিচারের কতকগুলো বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে সেসব বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো-
১. স্থান নির্ধারণ: স্থান নির্ধারণ হলো প্লেটোর ন্যায়বিচারের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য। তার মতে ন্যায়বিচার প্রত্যেক মানুষের জন্য সমাজে তার নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করে দেয়। এই নির্ধারণের ভিত্তি হলো তার প্রকৃতিগত ও শিক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত যোগ্যতা।
২. সামাজিক বন্ধনঃ প্লেটোর ন্যায়বিচারের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো, এটি সামাজিক বন্ধন স্বরূপ। এই বন্ধন সমাজকে সুসংহত করে এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদিগকে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করে।
৩. যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মবিভাগ: প্লেটোর ন্যায়বিচার প্রত্যেকের জন্য প্রকৃত যোগ্যতা ও শিক্ষার ভিত্তিত সমাজে তার নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করে দেয়।
৪. বিরোধহীন ন্যায়বিচারঃ প্লেটোর ন্যায়বিচার হলো বিরোধহীন ন্যয়। তাই এই ন্যায়বিচারের ন্যায় ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের প্রকৃতির মধ্যে কোনো মৌলিক বিরোধ তৈরি করে না। ফলে এই ধারণা একটি বিরোধহীন ধারণা।
৫. আধ্যাত্মিক পদ্ধতি: এটি ব্যক্তিসংঘাত ও শ্রেণীসংঘাতের জন্ম দেয় না। কারণ এটি আধ্যাত্মিক পদ্ধতি।
৬. চারিত্রিক বিকাশঃ চারিত্রিক বিকাশ হলো প্লেটোর ন্যায়বিচারের অন্যতম দিক। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যক্তির কর্মজীবনে যে নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয় তার ফলে উক্ত ব্যক্তির চারিত্রিক জীবনের বিকাশ ব্যাহত হয় না; বরং পরিপূর্ণতা লাভ করে।