বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যকে আখ্যানকাব্য বলার কারণ
বড়ু চণ্ডীদাস রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম আখ্যানকাব্য হিসেবে বিবেচিত। আখ্যানকাব্য এমন একধরনের সাহিত্য, যেখানে একটি মূল কাহিনির মাধ্যমে কবি শিল্পিতভাবে ঘটনা বা চরিত্রের বিকাশ ঘটান। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্টতই বিদ্যমান।
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ আখ্যানকাব্যের বৈশিষ্ট্যসমূহ
১. কাহিনিমূলক রচনা:
- ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে মূলত শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার প্রেমকে কেন্দ্র করে তিনটি ভাগে বিভক্ত একটি সুসংহত কাহিনি রচিত হয়েছে:
- দানলীলা: রাধা ও তার সখীদের সঙ্গে কৃষ্ণের দানখেলা।
- ভ্রান্তবিলাস: কৃষ্ণ ও রাধার দাম্পত্য দ্বন্দ্ব।
- নাগরলীলা: রাধার প্রতি কৃষ্ণের প্রেমের অভিব্যক্তি।
কাহিনি ধারাবাহিক এবং সুসংগঠিত। এই কাহিনি রোমান্স, দ্বন্দ্ব, এবং মৈত্রীর মিশ্রণে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
২. চরিত্রের বিকাশ:
- কাব্যে রাধা, কৃষ্ণ, সখী, এবং যশোদা প্রভৃতি চরিত্রগুলোর গভীর মানবিক রূপায়ণ দেখা যায়।
- রাধার প্রেম, অভিমান, কৃষ্ণের দুষ্টুমি ও কৌশলপূর্ণ প্রেমের কাহিনির মাধ্যমে চরিত্রগুলোকে জীবন্ত করে তোলা হয়েছে।
৩. সংলাপনির্ভর রচনা:
- আখ্যানকাব্যের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য সংলাপ। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে সংলাপের মাধ্যমে গল্প এগিয়ে যায়।
- উদাহরণ:
কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার কথা কাটাকাটি এবং সখীর মধ্যস্থতা কাহিনির গতিকে নাটকীয় করে তুলেছে।
৪. ঘটনা ও আবেগের চিত্রায়ণ:
- প্রেম, বিরহ, মিলন এবং দ্বন্দ্বের চমৎকার উপস্থাপন কাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
- উদাহরণ: রাধার অভিমানের দৃশ্য এবং কৃষ্ণের প্রেম নিবেদন কাব্যের আবেগপ্রবণ দিককে জীবন্ত করেছে।
৫. আখ্যানকাব্যের কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য:
- আখ্যানকাব্যে সাধারণত একটি কাহিনি ধারাবাহিকভাবে সাজানো থাকে, যা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এ স্পষ্ট।
- তিনটি ভাগে বিভক্ত হলেও কাহিনি একই সূত্রে বাঁধা এবং চরিত্রগুলো প্রতিটি অংশে সুনিপুণভাবে সংযুক্ত।
৬. ধর্মীয় ও মানবিক দৃষ্টিকোণ:
- যদিও এটি ধর্মীয় বিষয়ের ওপর রচিত, কাব্যে প্রেম ও মানবিক আবেগের মিশ্রণে তা বহুমাত্রিক হয়ে উঠেছে।
- এটি শ্রীকৃষ্ণকে ঐশ্বরিক চরিত্র থেকে মানবিক প্রেমিকের পর্যায়ে নিয়ে আসে, যা আখ্যানকাব্যের গুণাবলি।
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ আখ্যানকাব্য হওয়ার কারণের উপসংহার
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে কাহিনির ধারাবাহিকতা, চরিত্রের গভীরতা, সংলাপনির্ভর বর্ণনা, এবং মানবিক আবেগের উপস্থিতি একে নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের প্রথম আখ্যানকাব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। এটি শুধু কৃষ্ণ ও রাধার প্রেমকাহিনি নয়; বরং তৎকালীন সমাজ, সংস্কৃতি, এবং মানুষের মানসিকতার প্রতিফলন। তাই এর আখ্যানধর্মিতা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অসাধারণ স্থান দখল করে।