‘বনমাই-কাইকা’ নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি পরীক্ষা করুন।

‘বনমাই-কাইকা’ নীতি

ভূমিকা: জাপানের আধুনিক ইতিহাসে “বনমাই-কাইকা” (文明開化) শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই শব্দটির অর্থ হলো ‘সভ্যতা এবং উজ্জীবন’ বা ‘সভ্যতার উদ্ভব এবং বিকাশ’। এটি মূলত মেইজি যুগে (১৮৬৮-১৯১২) জাপানের সংস্কৃতির, সমাজের, এবং অর্থনীতির আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়াকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়। ১৮৬৮ সালে মেইজি রেস্টোরেশন ঘটে, যার মাধ্যমে শোগুন শাসন পদ্ধতির পতন এবং সম্রাটের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। বনমাই-কাইকা নীতি এই সময়ের একটি মূল নীতি ছিল, যার মাধ্যমে জাপান পশ্চিমি সংস্কৃতি, প্রযুক্তি এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া গ্রহণ করে নিজেকে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিল। এই নীতির মাধ্যমে জাপান তার প্রথাগত সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে পশ্চিমি আধুনিক রাষ্ট্রগুলির মত একটি শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হয়।

বনমাই-কাইকা নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য:

১. পশ্চিমি প্রযুক্তি বিজ্ঞান গ্রহণ: বনমাই-কাইকা নীতির আওতায়, জাপান পশ্চিমি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং শিল্পজাত প্রযুক্তি গ্রহণ করতে শুরু করে। মেইজি সরকারের অধীনে জাপান পশ্চিমি শিক্ষাব্যবস্থা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, এবং শিল্পায়ন গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের উন্নত করতে চেয়েছিল। এই সময়ে জাপানে রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ, আধুনিক কারখানা ও যন্ত্রপাতি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। জাপান, বিশেষ করে পশ্চিমি শক্তির প্রভাব থেকে শিক্ষা নিয়ে, তাদের প্রতিরক্ষা এবং শিল্পকলা শক্তিশালী করে তোলে।

২. শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার: বনমাই-কাইকা নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ। মেইজি সরকার শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার করেন, যা পশ্চিমি শিক্ষা পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। বিশেষ করে, পশ্চিমি শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে এবং জাপানি জনগণের মধ্যে শিক্ষার হার বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। স্কুলে শিক্ষার বিষয়বস্তুতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস, ইংরেজি ভাষা ও পশ্চিমি সংস্কৃতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।

৩. রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ: বনমাই-কাইকা নীতি অনুযায়ী, জাপান তার রাজনৈতিক কাঠামোও পরিবর্তন করে। মেইজি রেস্টোরেশন চলাকালীন, প্রথাগত শোগুন শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটে এবং নতুন কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, যার নেতৃত্বে সম্রাট মেইজি থাকেন। এই সরকারের মাধ্যমে, একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং জাপান একটি আধুনিক সাংবিধানিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এটি জাপানকে পশ্চিমি শক্তির সমকক্ষ হিসেবে গড়ে তোলে, যেখানে আইন, শাসনব্যবস্থা এবং সামরিক কাঠামো ছিল অনেক বেশি উন্নত ও শক্তিশালী।

৪. সামাজিক সংস্কার: জাপানের সমাজে সংস্কারের ফলে প্রথাগত সামুরাই শ্রেণী এবং কৃষক শ্রেণীর ভূমিকা হ্রাস পায়। সমাজের সমস্ত স্তরে পরিবর্তন আসে, এবং বিশেষ করে পুরানো সামুরাই শ্রেণীর ক্ষমতা কমে যায়। সামুরাইরা তাদের জমির অধিকার এবং বিশেষ সুবিধা হারায় এবং তারা একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে পরিণত হয়। মেইজি সরকার নতুন সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে শ্রেণী ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং মানুষের মধ্যে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

৫. বাণিজ্যিক এবং শিল্প উন্নয়ন: বনমাই-কাইকা নীতির আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বাণিজ্যিক এবং শিল্প খাতে পরিবর্তন। মেইজি সরকার দেশের শিল্পায়ন ও আধুনিকীকরণের জন্য পশ্চিমি শিল্প প্রযুক্তি ও উৎপাদন কৌশল গ্রহণ করে। বৃহৎ পরিসরে রেলপথ, সেতু, মেশিন সরঞ্জাম এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে জাপান দ্রুত শিল্পায়িত হয় এবং বিশ্ববাজারে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুত হয়।

৬. বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপন: বনমাই-কাইকা নীতির আওতায়, জাপান পশ্চিমি দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এই সময়ে জাপান অন্যান্য শক্তিশালী পশ্চিমি দেশগুলোর সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে, জাপান ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে এবং তাদের কূটনৈতিক দপ্তরকে শক্তিশালী করে তোলে।

৭. সামরিক আধুনিকীকরণ: বনমাই-কাইকা নীতির আওতায়, জাপান তার সামরিক শক্তি উন্নত করার জন্য পশ্চিমি দেশের আধুনিক যুদ্ধপ্রযুক্তি গ্রহণ করে। জাপান তার সামরিক বাহিনীতে ব্যাপক সংস্কার আনে, যেখানে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধ প্রযুক্তি, এবং প্রশিক্ষণ পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর ফলে, জাপান একটি শক্তিশালী সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়, যা পরবর্তীতে তাকে এশিয়ায় একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

প্রভাব এবং প্রতিক্রিয়া:

বনমাই-কাইকা নীতির ফলে, জাপান পশ্চিমি বিশ্বের সাথে সমানভাবে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল। এটি জাপানকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে বিশ্ব মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করে এবং তার সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করে। তবে, এই নীতির মাধ্যমে জাপানের প্রথাগত সংস্কৃতি, সমাজ, এবং রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন ঘটে, যা অনেকের কাছেই বিরোধী ছিল। বিশেষ করে, প্রথাগত সমাজ এবং ধর্মীয় সংস্কৃতির অনুসারীরা এই পরিবর্তনগুলোকে অগ্রহণযোগ্য মনে করেছিলেন।

অন্যদিকে, বনমাই-কাইকা নীতির কারণে জাপান আধুনিক বিশ্বে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করলেও, এটি জাপানি সমাজে এক ধরনের সাংস্কৃতিক ও মানসিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। একদিকে পশ্চিমি সংস্কৃতি এবং আধুনিকীকরণের প্রতি আকর্ষণ, অন্যদিকে প্রথাগত জাপানি মূল্যবোধ ও জীবনধারা রক্ষা করার প্রতি প্রবণতা ছিল। এর ফলে, সমাজে একধরনের বিভাজন তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে জাপানের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক নীতির মধ্যে একটি বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করে।

উপসংহার:

বনমাই-কাইকা নীতি জাপানের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচক। এটি শুধু জাপানকে একটি শক্তিশালী আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করার পন্থা ছিল না, বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, এবং সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করেছিল। এই নীতির মাধ্যমে, জাপান পশ্চিমি বিশ্বের সঙ্গে সমানভাবে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হয়েছিল, তবে এর ফলে প্রথাগত সমাজের সঙ্গে এক ধরনের সাংস্কৃতিক সংঘর্ষও সৃষ্টি হয়েছিল।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading