বাংলা প্রহসন রচনায় মধুসূদনের কৃতিত্ব-
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, যিনি বাংলা প্রহসন রচনায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। তাঁর রচিত প্রহসনসমূহ বাংলা নাট্যধারায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। বিশেষত, তাঁর দুটি প্রহসন— “একেই কি বলে সভ্যতা” এবং “বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ”—তাঁর প্রহসন রচনার অসাধারণ ক্ষমতা এবং সমাজ সচেতনতা প্রদর্শন করে।
প্রহসন ধারার বৈশিষ্ট্য ও মধুসূদনের অবদান
প্রহসন হলো এমন একটি নাট্যরীতি, যা হাস্যরসের মাধ্যমে সমাজের কদর্য, অযৌক্তিক ও ভণ্ডামিপূর্ণ দিকগুলো তুলে ধরে। মধুসূদন তাঁর প্রহসনগুলোতে সমকালীন সমাজের অসঙ্গতি, পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণ, কুসংস্কার এবং ভণ্ডামির ব্যঙ্গাত্মক চিত্র অঙ্কন করেছেন। তাঁর রচনায় রসবোধ ও তীক্ষ্ণ সমালোচনা দক্ষতার সঙ্গে মিশে গেছে, যা পাঠক ও দর্শকদের একাধারে মুগ্ধ এবং চমৎকৃত করে।
“একেই কি বলে সভ্যতা” (১৮৫৯)
এই প্রহসনটি মূলত সেই সময়ের ভারতীয় সমাজে পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণের তীব্র সমালোচনা। মধুসূদন এখানে ব্রাহ্ম সমাজের কিছু অসঙ্গতি এবং ইংরেজি শিক্ষার অপব্যবহারকে ব্যঙ্গ করেছেন। নাটকের কেন্দ্রে রয়েছেন এক দল শিক্ষিত কিন্তু বাস্তবজ্ঞানহীন বাঙালি, যারা নিজেদের ইংরেজীয় সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে তুলে ধরতে চায়। কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডে প্রকৃত সভ্যতার কোনো প্রকাশ দেখা যায় না। মধুসূদন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাদের ভণ্ডামি, নকল জীবনধারা এবং আচার-ব্যবহারের ত্রুটিগুলো উন্মোচন করেন।
“বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ” (১৮৫৯)
এই প্রহসনটি বাংলা সমাজে মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধ পুরুষদের যৌবনপ্রিয়তার একটি ব্যঙ্গাত্মক চিত্র। নাটকে দেখা যায়, মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি তার বয়সের তোয়াক্কা না করে তরুণীকে বিয়ে করার চেষ্টা করছেন। এই প্রসঙ্গটি মধুসূদন এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যা শুধু হাস্যরস সৃষ্টিই নয়, সমাজের গভীর অসঙ্গতিকেও তুলে ধরে।
ভাষা ও শৈলীর বৈচিত্র্য
মধুসূদনের প্রহসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর ভাষার নমনীয়তা ও শৈল্পিক দক্ষতা। নাটকে তিনি সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষা, ব্রিটিশদের ইংরেজি উচ্চারণ, এবং সংস্কৃত মিশ্রিত বাঙালির শিক্ষিত ভাষার মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। ফলে নাটকের চরিত্রগুলো অত্যন্ত জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর ব্যঙ্গ, রসবোধ এবং চরিত্রায়ণে বাস্তবতার গভীর ছোঁয়া স্পষ্ট।
সমাজ সচেতনতা ও মধুসূদনের সাহস
মধুসূদনের প্রহসন রচনার মূল প্রেরণা ছিল সমকালীন সমাজের অসঙ্গতিগুলোকে সামনে নিয়ে আসা এবং মানুষকে আত্মসমালোচনায় উদ্বুদ্ধ করা। তিনি সমাজের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের মুখোশ খুলে তাদের আসল রূপ দেখাতে পিছু হটেননি। এই বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলা নাট্যজগতে তাঁকে স্থায়ী আসন দিয়েছে।
উপসংহার
মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রহসনসমূহ বাংলা সাহিত্যে যুগান্তকারী অবদান রেখে গেছে। তাঁর রচনা শুধু হাস্যরসের জন্য নয়, বরং সামাজিক সচেতনতা ও তীব্র সমালোচনার মাধ্যমে বাংলা নাটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা প্রতিষ্ঠা করেছে। তাঁর প্রহসন রচনার সাহস, শৈল্পিক দক্ষতা, এবং সমাজ সংস্কারের দৃষ্টিভঙ্গি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে এবং পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।