বাস্তববাদী তত্ত্ব
বাস্তববাদী তত্ত্ব (Realism Theory) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি যা রাষ্ট্রসমূহের আচরণ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষণ করে। বাস্তববাদী তত্ত্বে, রাষ্ট্রসমূহকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা এবং নিরাপত্তা অর্জনের জন্য স্বার্থপর এবং আত্মরক্ষামূলক হিসেবে দেখা হয়। এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাস্তব পরিস্থিতি, শক্তির ভারসাম্য এবং রাষ্ট্রের স্বার্থের উপর জোর দেয়।
বাস্তববাদী তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্য:
- রাষ্ট্রের কেন্দ্রীকতা: বাস্তববাদীরা মনে করেন যে, রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রধান এবং প্রাথমিক একক। অন্য কোন অভিনেতা, যেমন আন্তর্জাতিক সংস্থা বা বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রের তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ।
- শক্তির ভারসাম্য: বাস্তববাদী তত্ত্বে শক্তির ভারসাম্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রগুলি তাদের নিরাপত্তা এবং স্বার্থ রক্ষায় শক্তির প্রয়োগ করতে প্রস্তুত থাকে। শক্তির ভারসাম্য পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যখন শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হয়, তখন যুদ্ধ এবং সংঘর্ষের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
- মানব প্রকৃতির ধরন: বাস্তববাদীরা বিশ্বাস করেন যে মানুষের প্রকৃতি inherently স্বার্থপর এবং ক্ষমতালোভী, এবং এই মানবিক বৈশিষ্ট্য আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রতিফলিত হয়। রাষ্ট্রগুলি এই স্বার্থের উপর ভিত্তি করে তাদের আচরণ নির্ধারণ করে।
- অস্তিত্ববাদী নিরাপত্তা: বাস্তববাদীরা বিশ্বাস করেন যে, রাষ্ট্রগুলি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সর্বদা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। এটি রাষ্ট্রগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে এবং এই প্রতিযোগিতা কখনও কখনও সংঘর্ষে পরিণত হতে পারে।
- আন্তর্জাতিক আনীত আইন ও নৈতিকতার অনুপস্থিতি: বাস্তববাদীরা দাবি করেন যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি মূলত নৈতিকতা বা আইনের উপর ভিত্তি করে চলে না, বরং এটি রাষ্ট্রগুলির স্বার্থ এবং ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। তাই, কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি বা আইন তাত্ত্বিকভাবে কার্যকর না হতে পারে যদি এটি রাষ্ট্রের স্বার্থের সাথে সংঘর্ষে পড়ে।
- আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা অরাজনৈতিক: বাস্তববাদীরা বিশ্বাস করেন যে, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা কোনো শাসক বা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের দ্বারা পরিচালিত নয়। বরং, এটি অনির্দিষ্ট, অরাজনৈতিক এবং বিশৃঙ্খল। রাষ্ট্রগুলি একে অপরের সাথে নিজেদের নিরাপত্তা এবং স্বার্থের দিক থেকে সম্পর্ক গড়ে তোলে, যা কখনো সহযোগিতামূলক আবার কখনো সংঘর্ষমুখী হতে পারে।
বাস্তববাদী তত্ত্বের প্রধান দার্শনিক ও প্রবর্তকরা:
- থুকিদাইডিস: প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ থুকিদাইডিস প্রথম “শক্তির রাজনীতি” ও “নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা” ধারণাগুলো তুলে ধরেন, যা পরবর্তীতে বাস্তববাদী তত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়। তার মতে, মানুষ এবং রাষ্ট্রের আচরণ মূলত স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল।
- নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি: ম্যাকিয়াভেলির মতে, রাষ্ট্র শাসককে তার ক্ষমতা বজায় রাখতে যা প্রয়োজন তা করতে হবে, যেটি প্রাথমিকভাবে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি তার বই “দ্য প্রিন্স” এ রাষ্ট্রশাসনের নীতিমালা প্রণয়ন করেন, যেখানে ক্ষমতা এবং প্রতিরক্ষা সব সময়ই প্রধান।
- হ্যান্স মোর্গেনথু: ২০ শতকের অন্যতম প্রধান বাস্তববাদী চিন্তাবিদ। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শক্তির ভারসাম্য এবং নিরাপত্তা প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। তাঁর “পলিটিকাল সিস্টেম অফ স্টেটস” বইটি বাস্তববাদী তত্ত্বের ভিত্তি।
বাস্তববাদী তত্ত্বের সমালোচনা:
- অতিরিক্ত যুদ্ধে প্রবণতা: বাস্তববাদী তত্ত্বের প্রবক্তাদের মতে, রাষ্ট্রগুলো সবসময় নিজের নিরাপত্তার জন্য প্রতিযোগিতা করে, যা আন্তর্জাতিক সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যায়। তবে, এটি অনেকসময় সহিংসতার প্রতি মনোভাব গড়ে তোলে, যাকে নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয় না।
- আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অবমূল্যায়ন: বাস্তববাদীরা আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে খুব কম গুরুত্ব দেয়, তবে আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি যেমন জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
- নারী ও মানবাধিকার উপেক্ষা: বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণভাবে মানবাধিকার এবং নারী-পুরুষ সমতার মতো মৌলিক নৈতিক ধারণাগুলো উপেক্ষা করে, যা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি নেতিবাচক বিষয়।
উপসংহার:
বাস্তববাদী তত্ত্ব আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী দৃষ্টিভঙ্গি যা রাষ্ট্রের স্বার্থ, শক্তির প্রয়োগ এবং নিরাপত্তাকে মূল প্রতিপাদ্য করে। যদিও এটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং নৈতিকতার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে, এটি বিশ্ব রাজনীতির অনেক জটিলতা এবং বাস্তবতা ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করে।