বৌদ্ধধর্ম এবং জৈন ধর্মের উত্থানের কারণগুলি কি কি ছিল? 

বৌদ্ধধর্ম এবং জৈন ধর্মের উত্থানের কারণগুলি

ভারতের ইতিহাসে বৌদ্ধধর্ম ও জৈন ধর্মের উত্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যেগুলি কেবল ধর্মীয় ইতিহাসের দৃষ্টিতে নয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও বিশাল প্রভাব ফেলেছিল। এ দুটি ধর্মই ঋকবৈদিক ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা এবং প্রথাব্যবস্থার প্রতি একটি শক্তিশালী বিরোধিতা হিসেবে উঠে আসে এবং এর প্রতিষ্ঠা ছিল যুগান্তকারী। এর মাধ্যমে ভারতীয় সমাজে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবনদর্শন উদ্ভাবিত হয়। বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা সিদ্ধার্থ গৌতম (বুদ্ধ) এবং জৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর স্বামী—এই দুটি ধর্মের মূল দর্শন মানুষকে আত্মানুসন্ধান, অহিংসা, পরিস্কার চিন্তা ও নৈতিক জীবনযাপন সম্পর্কে সচেতন করেছিল।

বৌদ্ধধর্ম এবং জৈন ধর্মের উত্থানের পিছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, এবং দর্শনীয় কারণ ছিল। এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করবো, কেন এবং কিভাবে বৌদ্ধধর্ম এবং জৈন ধর্ম ভারতীয় সমাজে উত্থান লাভ করেছিল এবং তাদের জনপ্রিয়তার পেছনে কী কারণ ছিল।

১. ঋকবৈদিক ধর্মের প্রথাগত কাঠামো তার সীমাবদ্ধতা

ঋকবৈদিক ধর্মের মূল ভিত্তি ছিল প্রাকৃতিক শক্তি এবং দেবতাদের উপাসনা, যেখানে ব্রাহ্মণরা বিশেষ ভূমিকা পালন করতেন। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, পশুবলি, যজ্ঞ, এবং মন্দিরের নানা ধর্মীয় বিধি-নিষেধ ছিল। তবে এই প্রথাগুলির মধ্যে কয়েকটি সমস্যা ছিল, যেমন:

  • কঠোর ব্রাহ্মণিক প্রথা: ব্রাহ্মণরা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন, কিন্তু তারা সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মীয় ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করে রেখেছিলেন। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নিম্নবর্ণের মানুষের জন্য ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সম্পাদন অসম্ভব ছিল। এই কারণে ঋকবৈদিক ধর্মের মধ্যে একটি সামাজিক এবং ধর্মীয় অসামঞ্জস্যতা সৃষ্টি হয়েছিল।
  • কর্মকাণ্ডের প্রতি অসন্তুষ্টি: ভিন্ন জাতি এবং সমাজের মানুষদের জন্য কঠোর বিধি ছিল, যারা দীক্ষা নিতে বা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করতে পারতেন না। তবে, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্ম এই অসামঞ্জস্যতাগুলির প্রতি এক ধরনের বিরোধিতা হিসেবে উত্থিত হয়, যেখানে ধর্মীয় চেতনা ছিল সহজতর এবং আত্মবিশ্বাসের উপরে ভিত্তি করে।

২. সামাজিক রাজনৈতিক পরিবর্তন

বৌদ্ধধর্ম এবং জৈন ধর্মের উত্থানে সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ঋকবৈদিক যুগের পরবর্তী সময়কাল—যতটা রাজনৈতিক সঞ্চালন ঘটেছিল, ততটাই সমাজের ভিন্ন ভিন্ন দিকেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। বিশেষত মাগধ সাম্রাজ্য, কোষল সাম্রাজ্য, এবং কঞ্চী (যতীন্দ্র) রাজ্য সহ বিভিন্ন রাজ্যগুলির প্রতিষ্ঠা, যেগুলি বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী ও দর্শনকে সমর্থন করেছিল।

২.১. ভগবান এবং ব্রাহ্মণদের শক্তির বিপরীতে নতুন ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি

এই সময়ের রাজারা বিশেষত যাদের শাসনকাল ছিল মাগধে, তারা ব্রাহ্মণদের শক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে শুরু করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বুদ্ধ এবং মহাবীর স্বামীর ধারণা ছিল যে, “যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণ” ধর্মের প্রধানতা এবং আচার-অনুষ্ঠানকে সাধারণ মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তা সবার জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। এর ফলে তাদের সৃষ্ট ধর্মীয় দর্শন নতুন সমাজ ও মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।

৩. বৌদ্ধধর্মের উত্থানের কারণ

৩.১. সিদ্ধার্থ গৌতমের ব্যক্তিগত জীবনের প্রভাব

গৌতম বুদ্ধ ছিলেন একজন রাজপুত্র, যিনি একদা রাজ্য ও বিলাসী জীবন ত্যাগ করে সাধনার পথে চলতে শুরু করেন। তার জীবনের এই পরিবর্তনটি প্রভাবিত করেছিল সমাজের সকল স্তরের মানুষকে। তিনি তার জীবনের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে দুঃখের উৎপত্তি, কারণ এবং তার সমাধান নিয়ে চিন্তা করেছিলেন। তিনি তার অনুসারীদের কাছে জানাতে চেয়েছিলেন যে, জীবনের মূল লক্ষ্য হল দুঃখের কারণগুলি নির্ধারণ এবং সেই দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে আত্মসংযম ও সাধনার মাধ্যমে মুক্তি লাভ করা। গৌতম বুদ্ধের দর্শন ছিল যে, “দুঃখ” আমাদের সমাজ ও জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, কিন্তু তাতে কোন পরিত্রাণও রয়েছে।

৩.২. অহিংসা এবং নৈতিক জীবনযাত্রার প্রতি গুরুত্ব

বৌদ্ধধর্মের মূল দর্শনগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল অহিংসা এবং ত্যাগ। অহিংসার মাধ্যমে মানুষ ধর্মের মর্ম উপলব্ধি করতে পারে, এবং মানুষ যতটা সম্ভব ক্ষতি বা যন্ত্রণা থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করবে। এটি ছিল কেবল ধর্মীয় নয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলতে সক্ষম একটি দর্শন। এই মহান ধারণা মানুষের সমান অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা স্থাপন করেছিল এবং এটি জনগণের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।

৩.৩. বুদ্ধের তত্ত্বের প্রভাব

বুদ্ধের তত্ত্বে চার মহাযুগ (চার মহাচিত্র) (দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখের সমাধান, এবং সমাধান) সমাজের মনের গভীরে পৌঁছাতে সক্ষম ছিল। তিনি দুঃখের উৎপত্তি এবং তার মুক্তির জন্য যে পথ দেখিয়েছেন তা মূলত অষ্টাঙ্গিক মার্গ (অষ্টাঙ্গিক পথ) এবং আত্মসাধনা ছিল। এর ফলে বৌদ্ধধর্ম অল্প সময়ের মধ্যে একদিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসম্পন্ন গোষ্ঠী এবং অন্যদিকে সাধারণ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।

৪. জৈন ধর্মের উত্থান

জৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর স্বামী ছিলেন একাধারে একজন সমাজ সংস্কারক এবং দর্শনদ্রষ্টা। তিনি মূলত ঋকবৈদিক ধর্মীয় প্রথা ও ব্রাহ্মণিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে এক ধীর, সংযত, এবং যুক্তিসঙ্গত ধর্মীয় দর্শন প্রতিষ্ঠা করেন। জৈন ধর্মের প্রধান বিষয় হল অহিংসা, ত্যাগ, এবং আত্মবিশ্বাস।

৪.১. অহিংসা এবং আত্মবিশ্বাসের প্রচলন

মহাবীর স্বামী অহিংসার গুরুত্বকে বিশেষভাবে প্রচার করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, প্রত্যেক জীবের মধ্যে জীবিত আত্মা রয়েছে এবং তাই এক জীবের উপর অন্য জীবের অত্যাচার করা উচিত নয়। এ কারণে তিনি নিরামিষাশী খাদ্যাভ্যাসের প্রচলন এবং শারীরিক, মানসিক, এবং আধ্যাত্মিক বিশুদ্ধতার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন।

৪.২. ব্রাহ্মণিক প্রথার বিরোধিতা

মহাবীর স্বামী, ঋকবৈদিক ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান ও ব্রাহ্মণিক কর্তৃত্বের বিরোধিতা করে ধর্মীয় সমতাবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার শিষ্যদের সাধারণ জীবনযাপন, দান-ধ্যান এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে মহাশক্তি অর্জনের শিক্ষা দিতেন।

৫. বৌদ্ধধর্ম এবং জৈন ধর্মের সার্বজনীন দিক

বৌদ্ধধর্ম এবং জৈন ধর্ম উভয়ই সামাজিক ও ধর্মীয় দিক থেকে সার্বজনীন ছিল। যেখানে ঋকবৈদিক ধর্মে কেবল উচ্চবর্ণের লোকজনই ধর্মীয় কাজে নিযুক্ত হতে পারতেন, সেখানে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। তাই, সাধারণ মানুষ তাদের ধর্মীয় দীক্ষা গ্রহণ করতে পারতেন এবং তারা জীবনের মূূল উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

উপসংহার

বৌদ্ধধর্ম ও জৈন ধর্মের উত্থান ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সামাজিক বিপ্লব, যা প্রাচীন ভারতীয় সমাজের ভাঙন, পরিবর্তন এবং নতুন আশার সূচনা করেছিল। এই ধর্মগুলি কেবল ধর্মীয় শাস্ত্র ও আচার-অনুষ্ঠানের প্রশ্নে নয়, বরং মানুষের অন্তর্নিহিত আত্মিক উন্নতি ও সমাজের নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা, এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রশ্নেও গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিল।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading