Discuss the status of Lifelong Learning in British India.
ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে, যার ফলে আজীবন শিক্ষার ধারণা একটি নতুন আকার লাভ করে। ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব, নতুন শিক্ষাব্যবস্থা, এবং সমাজের পরিবর্তন শিক্ষার গঠন ও কার্যক্রমে গভীর প্রভাব ফেলে। ব্রিটিশ শাসনামলে প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি পশ্চিমা ধাঁচের শিক্ষার প্রচলন হয়, যা আজীবন শিক্ষার ধারাকে নতুনভাবে চিত্রিত করে।
ব্রিটিশ শাসনামলে শিক্ষার প্রেক্ষাপট:
ব্রিটিশ শাসনের আগে ভারতীয় সমাজে শিক্ষা ছিল প্রায় সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় এবং ঐতিহ্যবাহী ভিত্তিতে পরিচালিত। গুরুকুল, পাঠশালা, মাদ্রাসা, এবং মঠগুলি ছিল প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র, যেখানে ধর্মীয় গ্রন্থ, দর্শন, নীতি, এবং অন্যান্য প্রথাগত বিষয়গুলি শেখানো হতো। শিক্ষার এই পদ্ধতিটি জীবনব্যাপী ছিল, তবে তা ছিল নির্দিষ্ট সম্প্রদায় এবং সামাজিক শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ।
ব্রিটিশ শাসনামলে শিক্ষার পদ্ধতিতে বিশাল পরিবর্তন আসে। ১৮১৩ সালে চার্টার অ্যাক্টের মাধ্যমে সরকার কর্তৃক শিক্ষায় হস্তক্ষেপ শুরু হয়, এবং ১৮৩৫ সালে লর্ড ম্যাকলে’র শিক্ষা সংস্কার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর ফলে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার প্রবর্তন হয় এবং পাশ্চাত্য ধাঁচের শিক্ষার প্রসার ঘটে।
ব্রিটিশ ভারতে আজীবন শিক্ষার উপাদান:
১. প্রথাগত শিক্ষার অবক্ষয় ও পশ্চিমা শিক্ষার প্রভাব:
ব্রিটিশ শাসনামলে প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং পশ্চিমা শিক্ষার প্রভাব বৃদ্ধি পায়। ইংরেজি ভাষা, বিজ্ঞান, গণিত, এবং পাশ্চাত্য সমাজবিজ্ঞান ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাধান্য পায়। এর ফলে প্রাচীন শাস্ত্র, দর্শন, এবং ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান পিছিয়ে পড়ে। শিক্ষার এই নতুন ধারা একটি নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, প্রথাগত শিক্ষার কিছু অংশ জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে অব্যাহত ছিল।
২. আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিকাশ:
ব্রিটিশ শাসনের অধীনে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭), বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭), এবং মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭) এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়, যা আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটায়। তবে এই শিক্ষা ছিল মূলত প্রাতিষ্ঠানিক এবং একটি নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরের শিক্ষার সুযোগ সীমিত ছিল।
৩. কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও সুযোগ:
ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের অর্থনীতিতে প্রচুর পরিবর্তন আসে এবং এর ফলে কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। কৃষি, কারিগরি, এবং অন্যান্য পেশাদারদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। সরকারি স্কুল এবং কারিগরি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই ধরণের শিক্ষা প্রদান করা হয়, যা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। বিশেষ করে, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলি কর্মজীবী মানুষদের জন্য একটি আজীবন শিক্ষার সুযোগ তৈরি করে।
৪. মহিলা শিক্ষার বিকাশ:
ব্রিটিশ শাসনামলে মহিলা শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু উন্নতি হয়। বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়, এবং অন্যান্য সমাজ সংস্কারকদের প্রচেষ্টায় মহিলা শিক্ষার প্রসার ঘটে। তবে, এই শিক্ষা প্রাথমিকভাবে উচ্চবর্ণের মহিলাদের জন্য সীমাবদ্ধ ছিল এবং তা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধার কারণে সীমিত আকারে রয়ে যায়। মহিলা শিক্ষার প্রসারে ব্রিটিশ শাসন কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখে, যা পরবর্তীতে তাদের সামাজিক অবস্থান উন্নত করতে সহায়ক হয়।
৫. প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার উদ্যোগ:
ব্রিটিশ শাসনামলে প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার গুরুত্ব ধীরে ধীরে উপলব্ধি করা হয়। বিভিন্ন সমাজ সংস্কারক, মিশনারি এবং বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এই উদ্যোগগুলির মধ্যে বই, সংবাদপত্র, এবং পাঠাগারের মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করা হয়। প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার এই প্রচেষ্টা বিশেষত শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল এবং গ্রামীণ অঞ্চলে এর প্রভাব ছিল সীমিত।
৬. সংবাদপত্র এবং প্রকাশনার ভূমিকা:
ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় সমাজে সংবাদপত্র এবং প্রকাশনার প্রসার ঘটে, যা একটি অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। বাংলা, হিন্দি, উর্দু, এবং অন্যান্য ভাষায় প্রচুর পত্রিকা, সাময়িকী, এবং বই প্রকাশিত হয়, যা জনগণের মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ তৈরি করে। এই ধরনের শিক্ষার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা এবং সামাজিক আন্দোলনের উত্থান ঘটে।
ব্রিটিশ ভারতে আজীবন শিক্ষার সীমাবদ্ধতা:
ব্রিটিশ শাসনামলে আজীবন শিক্ষার ধারণা কিছুটা বিস্তৃত হলেও, তা ছিল সীমিত এবং অনেক বাধার সম্মুখীন।
১. সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য:
ব্রিটিশ শাসনামলে শিক্ষার সুযোগ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে খুবই সীমিত ছিল। উচ্চবর্ণ এবং ধনী ব্যক্তিরাই প্রাথমিকভাবে শিক্ষার সুযোগ পেত, যেখানে দরিদ্র এবং নিম্নবর্ণের মানুষ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। এই বৈষম্য জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে শিক্ষার সুযোগকে সীমাবদ্ধ করে রাখে।
২. শিক্ষার পদ্ধতি ও লক্ষ্য:
ব্রিটিশ শাসনামলে শিক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল প্রশাসনিক কাজের জন্য দক্ষ কর্মী তৈরি করা। এর ফলে শিক্ষা প্রায় একঘেয়ে এবং তাত্ত্বিক হয়ে পড়ে। প্রথাগত শিক্ষার প্রতি অবহেলা এবং নতুন শিক্ষার কাঠামো আজীবন শিক্ষার ধারণাকে বিকশিত হতে বাধা দেয়। শিক্ষার এই পদ্ধতি ব্যক্তিগত বিকাশের চেয়ে প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির উপর বেশি জোর দেয়।
৩. নারী ও নিম্নবর্ণের শিক্ষার সুযোগের অভাব:
নারী এবং নিম্নবর্ণের মানুষদের শিক্ষার সুযোগ প্রায় অনুপস্থিত ছিল। যদিও কিছু সামাজিক আন্দোলন এবং উদ্যোগের মাধ্যমে তাদের শিক্ষার সুযোগের প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, তবে তা পর্যাপ্ত ছিল না। শিক্ষার এই সীমাবদ্ধতা সমাজের একটি বৃহত্তর অংশকে আজীবন শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে।
৪. স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতির অবনতি:
ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার একটি নেতিবাচক দিক ছিল স্থানীয় ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি অবহেলা। ইংরেজি ভাষা এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়, যার ফলে স্থানীয় ভাষা এবং সংস্কৃতি অবহেলিত হয়। এই কারণে স্থানীয় ভাষায় শিক্ষার সুযোগ হ্রাস পায়, যা একটি বৃহৎ অংশের মানুষের জন্য আজীবন শিক্ষার পথকে সংকীর্ণ করে।
উপসংহার:
ব্রিটিশ ভারতে আজীবন শিক্ষার ধারণা কিছুটা পরিবর্তিত হয় এবং নতুন শিক্ষাব্যবস্থা ও পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে কিছু নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়। তবে সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক বৈষম্য শিক্ষার সুযোগকে সীমাবদ্ধ করে রাখে। প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থার পতন এবং নতুন শিক্ষাব্যবস্থার বিকাশের ফলে শিক্ষার ধারা পরিবর্তিত হয়, কিন্তু আজীবন শিক্ষার উদ্দেশ্য এবং সুযোগের মধ্যে কিছু সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়। তা সত্ত্বেও, ব্রিটিশ শাসনামলে শিক্ষার কিছু নতুন দিক উঠে আসে, যা পরবর্তীতে ভারতের শিক্ষা ও সমাজে প্রভাব ফেলেছিল এবং আজীবন শিক্ষার ধারণার বিকাশে ভূমিকা রাখে।