ভাওয়াইয়া, ঝুমুর, ভাদু, ঘেঁটু ও গাজনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

ভাওয়াইয়া:

ভাওয়াইয়া গান হচ্ছে উত্তরবঙ্গের অরণ্য ও প্রকৃতিবাহিত জনমানুষের লোকসংগীত উত্তরবঙ্গের অরণ্য প্রকৃতির গাম্ভীর্যপূর্ণ মৌনতা, নদনদীর ক্ষিপ্র গতি, সেখানকার মানুষের মন দ্বারা বাহিত হয়ে সুর তাল ছন্দ নিয়ে রূপ পেয়েছে ভাওয়াইয়া লোকগান (ইংরেজি: Bhawaiya song)। লেখক তপন রায় উল্লেখ করেছেন যে, ‘উত্তরাঞ্চল বা উত্তরবঙ্গের ধারাগুলোর প্রধান ধারাটি ভাওয়াইয়া’। ভাওয়াইয়া কথাটির উৎপত্তি সম্পর্কে অনেক মতভেদ রয়েছে। ভাব (মনের অনুভূতি) ভাও+ইয়া; অর্থাৎ যে সমস্ত গানের মধ্য দিয়ে গহিন মনের অনুভূতি প্রকাশ করা হয় তাই ভাওয়াইয়া।
ভাওয়াইয়া গানের সুর চড়া এবং সেই সুরের মধ্যে অনেক ভাঁজ এবং কাজ পরিলক্ষিত হয়। উত্তরবঙ্গের রংপুর, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, কুড়িগ্রাম, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি ও গোয়ালপাড়া জেলার অধিবাসীদের মধ্যে এ গানের প্রচলন দেখা যায়।

ভাওয়াইয়ার বিষয়বস্তু


ভাওয়াইয়া গান বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে চার ধরনের। এইগুলো হচ্ছে প্রণয়, চটকা, ক্ষীরোল, এবং ভাবপ্রধান। এ গানগুলোতে স্থানীয় সংস্কৃতি, জনপদের কৃষিজীবী জীবনযাত্রা, তাদের কর্মক্ষেত্র, পারিবারিক ঘটনাবলী ইত্যাদির সার্থক প্রয়োগ ঘটেছে। গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক জীবন ও জীবিকাকে কেন্দ্র করে ভাওয়াইয়ার ভাগ করলে পাওয়া যায় গাড়িয়াল গান, মৈষাল বন্ধুর গান, এমনকি হাতির মাহুত বন্ধুর গান

ঝুমুর গান কী?


ঝুমুর গান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড ও উড়িষ্যা রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রচলিত লোকগীতি বিশেষ। বঙ্গ বা বাংলা অর্থাৎ আধুনিক বাংলাদেশ ও আধুনিক ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে প্রাচীনকাল হতে প্রচলিত লোকগীতির ধরনসমূহের মধ্যে ঝুমুর গান একটি। ঝুমুর গান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পূর্ব মেদিনীপুর ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা; ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সাঁওতাল পরগণা, সিংভূম, রাঁচি, হাজারিবাগ, পালামৌ, গিরিডি, ধানবাদ ও বোকারো জেলা এবং উড়িষ্যা রাজ্যের ময়ূরভঞ্জ, সুন্দরগড়, কেঁওনঝাড় ও সম্বলপুর জেলা ইত্যাদি এক বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রচলিত।
বাংলার অন্যতম প্রাচীন জনপদ রাঢ়, ঝাড়খণ্ড, বিহার এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলের লোকসঙ্গীতের একটি প্রকরণ হলো। মূলত ঝুমুর হলো গান, নাচ, তাল ও গায়নশৈলী নিয়ে একটি সাধারণ লোকসঙ্গীতের ধারা।

ঝুমুর গানের ইতিহাস:


পূর্বে ঝুমুর গানগুলি মুখে মুখে রচিত হত, দাঁড় নাচের গান হিসেবে ব্যবহৃত হত এবং কোন ভণিতা বা পদকর্তার উল্লেখ থাকতো না। কিন্তু চৈতন্য পরবর্তী যুগে ভণিতাযুক্ত ঝুমুরের সূচনা হয় এবং ধীরে ধীরে নৃত্যে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ হলে পুরুষদের মহিলা সেজে দাঁড় নাচে অংশগ্রহণের প্রচলন শুরু হয়। এই সময় ঝুমুর গানের ওপর ভিত্তি করে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও কীর্তনের সুরে নাচনী নাচ ও দরবারী ঝুমুরের প্রচলন হয়। এই সময়ের ঝুমুরে পুরাণকাহিনি, সহজিয়া বাউলতত্ত্ব এবং রাধা কৃষ্ণের প্রেম বিষয়ক বৈষ্ণব ভক্তিতত্ত্ব স্থান পায়। ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী ঝুমুর গান বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার ওপর রচিত হওয়া শুরু হয়।

ভাদু:


ভাদু উৎসব ভাদ্র মাসের উৎসব। ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির দিনে ভাদু পুজো হয়ে থাকে। ব্রতের ক্ষেত্রে ভাদ্র মাসের প্রারম্ভেই শুরু হয় মেয়েলি ব্রত। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এবং লাগোয়া, বিহার, ঝাড়খণ্ডের দু-একটা জেলায় প্রধানত ভাদু উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।


আদিবাসী, সাঁওতালদের মধ্যে করম গান ও উৎসবে পালন করার রীতি রয়েছে বর্ষাকালে। তা-ও বিশেষ ভাবে ভাদ্র মাসে। বর্ষা উৎসবের এই করম গানের হিন্দু সংস্করণ হিসেবে ভাদু গানকে ধরেছেন আশুতোষ ভট্টাচার্য। তিনি ভাদু গানকে আর্যেতর সমাজ উদ্ভূত ধরে, হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতার প্রভাবজাত বলেছেন।


পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুরের কিছু অংশ, আসানসোল মহকুমা, ঝাড়খন্ডের রাঁচি, হাজারিবাগে পালিত হচ্ছে এই উৎসব। কথিত আছে, পঞ্চকোট রাজপরিবারের রাজকন্যা ভদ্রাবতীর বিয়ের দিন বিয়েবাড়িতে ডাকাত পড়ে। সেখানেই খুন হন বরযাত্রী সহ ভদ্রাবতীর স্বামী। আর সেই শোকেই আত্মহত্যা করেন ভদ্রাবতী। এই ঘটনা স্মরণ করেই ভাদু পুজো।
ভাদুর লৌকিক গল্পটি এইরকম:


”বর চলেছে বিয়ে করতে । পালকিতে বরের সাথে বরের বাপ ,বড়ো ভাই। সব মিলিয়ে জনাদশেক বরযাত্রী। সব মিলিয়ে তিনটে পালকি। সঙ্গে দুজন লেঠেল। সকাল রওনা দিয়েছে ওরা । কনে হল পঞ্চকোট রাজার মেয়ে ভদ্রাবতী।”


”সাত সকালে রওনা দিয়ে মানভূমের মালভূমি আর পাহাড় ডিঙিয়ে জঙ্গল মহলের পথ ধরে পালকি চলেছে। পালকি বেয়ারাদের ‘হুহুম না হুহুম না’ ফিরে ফিরে আসছিল পাহাড় থেকে পাহাড়ে । তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছে বেহারাগুলো, সন্ধ্যে নামার আগেই পেরোতে হবে জঙ্গল ।
কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবার মুখে জঙ্গলের সামনে এসে দাঁড়ালো বর যাত্রীর দল। ঠিক হল রাত ভোর হলে ওরা আবার রওনা দেবে। সেইমতো দুটো ভাত ফুটিয়ে নেবার আয়োজন হল। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে। পরদিন খুব ভোরে রওনা দিতে হবে যে। সবে মাত্র দু-গাল ভাত মুখে তুলেছে বেহারাগুলো , একটা অদ্ভুত শব্দে সবাই চমকে উঠল।”


সেই শিস শুনে বেহারাগুলোর চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে উঠল। ভাতের থালা ফেলে ওরা ছুটে পালাল জঙ্গলের মধ্যে।বরযাত্রীর দল কিছু বুঝে উঠবার আগেই ‘হারে রে রে রে রে’! করে ঝাঁপিয়ে পড়ল ডাকাতদল ।”


,” ভদ্রাবতীর গায়ে হলুদ শেষ। ছাঁদনা তলায় আঁকা হচ্ছে বিয়ের আলপনা । রান্না ঘরের পাশের খোলা উঠোনে সামিয়ানা টানিয়ে চলছে আপ্যায়নের তোড়জোড়। দপ্তরীখানায় বসে গড়গড়া মুখে নায়েবের সাথে বরকে বরণ করার তোড়জোর করছিলেন রাজা নীলমণি সিংদেও । বজ্রপাতের মতো খবরটা এল সে সময়ই। বর ও বরযাত্রী সকলেই ডাকাতদের হাতে নিহত হয়েছে। নহবত থেমে গেল। ”
”আর একটা কিংবদন্তী আছে। ছাতনা রাজার সাথে পঞ্চকোটের রাজার যুদ্ধ হয়েছিল ভাদ্রমাসে। তাতে পঞ্চকোটের রাজা জয়ী হন। সেই বিজয়কে মনে রেখেই নাকি ভাদু উৎসব।”

ঘেঁটু ও গাজনের:


গাজন উৎসব ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে উদযাপিত একটি হিন্দুধর্মীয় লোকউৎসব। এই উৎসব শিব, নীল, মনসা ও ধর্মঠাকুরের পূজাকেন্দ্রিক উৎসব। মালদহে গাজনের নাম গম্ভীরা এবং জলপাইগুড়িতে গমীরা। চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ জুড়ে সন্ন্যাসী বা ভক্তদের মাধ্যমে শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়। চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক পূজার সঙ্গে এই উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। ধর্মের গাজন সাধারণত বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে পালিত হয়। চৈত্রমাস ছাড়া বছরের অন্যসময় শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হলে তাকে হুজুগে গাজন বলা হয়। গাজন সাধারণত তিনদিন ধরে চলে। এই উৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল মেলা।


গাজনের সন্ন্যাসী বা ভক্তরা নিজেদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রণা দিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ইষ্ট দেবতাকে সন্তোষ প্রদানের চেষ্টা করেন। গাজন উপলক্ষ্যে তারা শোভাযাত্রা সহকারে দেবতার মন্দিরে যান। শিবের গাজনে দু’জন সন্ন্যাসী শিব ও গৌরী সেজে এবং অন্যান্যরা নন্দী, ভৃঙ্গী, ভূতপ্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতির সং সেজে নৃত্য করতে থাকেন। শিবের নানা লৌকিক ছড়া আবৃত্তি ও গান করা হয়। চৈত্রসংক্রান্তির গাজনে কালী নাচ একটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। ধর্মের গাজনের বিশেষ অঙ্গ হল নরমুণ্ড বা গলিত শব নিয়ে নৃত্য বা মড়াখেলা (কালিকা পাতারি নাচ)। জ্যৈষ্ঠমাসে মনসার গাজনে মহিলা সন্ন্যাসী বা ভক্ত্যারা অংশ নেয়, তারা চড়কের সন্ন্যাসীদের মতোই অনুষ্ঠান পালন করে।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading