ভারতের জাতীয় মহাফেজখানা’র ইতিহাস লেখো।

ভারতের জাতীয় মহাফেজখানা ইতিহাস ও বিবরণ:

ভারতের জাতীয় মহাফেজখানা, বা National Archives of India (NAI), ভারতের ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ ও গবেষণার একটি প্রধান কেন্দ্র। এর ইতিহাস এবং বিকাশ ভারতীয় ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে ভারতের জাতীয় মহাফেজখানা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, তার বিভিন্ন পর্যায়, এবং এর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

১. জাতীয় মহাফেজখানার জন্ম এবং প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায় (১৮৮৬–১৯৩৭)

A. প্রাথমিক পটভূমি

•             ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল: ১৮৮৬ সালে, ব্রিটিশ রাজের প্রশাসনিক নথিপত্র সংরক্ষণের জন্য প্রথম উদ্যোগ গৃহীত হয়। ঔপনিবেশিক সরকারের বিভিন্ন অফিসিয়াল নথি ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল সংরক্ষণের জন্য একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।

B. প্রথম মহাফেজখানা

•             প্রতিষ্ঠা: ১৮৮৬ সালের ১১ মার্চ-এ, কলকাতায় The Imperial Record Room নামে প্রথম মহাফেজখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ব্রিটিশ রাজের সরকারি নথিপত্র সংরক্ষণের জন্য একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল।

•             অবস্থান: কলকাতার নবান্ন ভবন এ প্রথম অবস্থান ছিল। পরবর্তীতে এই মহাফেজখানার কার্যক্রম নতুন ভবনে স্থানান্তরিত হয়।

C. প্রথম ব্যবস্থাপনা

•             প্রথম পরিচালক: প্রথম মহাফেজখানার পরিচালক হিসেবে পদে নিযুক্ত হন ইউস্টেস সি. কেব্বেল।

২. জাতীয় মহাফেজখানার পুনর্গঠন এবং আধুনিকীকরণ (১৯৩৭–১৯৪৭)

A. পুনর্গঠন

• নতুন নাম: ১৯৩৭ সালে, মহাফেজখানার নাম পরিবর্তন করে National Archives of India রাখা হয়। এটি ঔপনিবেশিক সরকার কর্তৃক একটি বৃহত্তর উদ্যোগের অংশ হিসেবে গৃহীত হয়েছিল।

•  অবস্থান: নতুনভাবে, দিল্লি-এর রাজপথ এ একটি নতুন ভবনে মহাফেজখানার কার্যক্রম শুরু হয়।

•  প্রথম অধ্যক্ষ: ড. জর্জ গিলbert স্কট হলেন প্রথম অধ্যক্ষ যিনি মহাফেজখানার নতুন ভবন ও কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন।

B. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব

•             নথিপত্র সংগ্রহ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে, বিভিন্ন যুদ্ধ সংক্রান্ত নথি এবং দলিল সংগ্রহ করা হয়।

৩. স্বাধীনতার পর জাতীয় মহাফেজখানার নতুন দিগন্ত (১৯৪৭–বর্তমান)

A. স্বাধীনতার পর আধুনিকীকরণ

•  স্বাধীনতার পর সংরক্ষণ: ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর, নথির নতুন সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়। নতুন ঐতিহাসিক দলিল, স্বাধীনতার দলিল, এবং ভারত সরকারের বিভিন্ন নথি সংগ্রহ করা হয়।

•  অধিনায়ক: মি. এন. গোপাল ছিলেন ১৯৫০-এর দশকে মহাফেজখানার প্রধান। তার নেতৃত্বে, মহাফেজখানা নতুন প্রক্রিয়া এবং প্রযুক্তির সাহায্যে আধুনিকীকরণের কাজ শুরু করে।

B. আধুনিক প্রযুক্তি ও সম্প্রসারণ

• তথ্যপ্রযুক্তি: ১৯৮০-এর দশকে, তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে মহাফেজখানার নথিপত্র ডিজিটাইজেশনের কাজ শুরু হয়।

•  নতুন উদ্যোগ:

• অর্কাইভসের ডিজিটাইজেশন: নথি ডিজিটাইজেশনের প্রকল্প শুরু হয় এবং ARCHIVES MANAGEMENT SYSTEM (AMS) প্রবর্তন করা হয়।

•  প্রদর্শনী ও শিক্ষা: জনগণের জন্য প্রদর্শনী এবং শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।

C. জাতীয় মহাফেজখানার বর্তমান অবস্থা

• সংগঠনের সেবাসমূহ:

•  নথি সংরক্ষণ: স্বাধীন ভারতের ইতিহাস, সরকারি নথি, মুদ্রা, ও পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ।

•  গবেষণা সহায়তা: গবেষক ও গবেষণার জন্য নথি সরবরাহ এবং সহায়তা।

•  প্রদর্শনী ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম: প্রদর্শনী আয়োজন এবং শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা।

•  বর্তমান পরিচালক: বর্তমানে ড. সুভাষ রঞ্জন দত্ত জাতীয় মহাফেজখানার পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

৪. ভারতের জাতীয় মহাফেজখানার প্রধান কার্যক্রম ও দায়িত্বসমূহ

A. নথি সংরক্ষণ

•             সরকারি নথি: ভারতের বিভিন্ন সরকারি সংস্থা এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নথি সংরক্ষণ।

•             ঐতিহাসিক নথি: ভারতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল, মুদ্রা, পাণ্ডুলিপি ইত্যাদি সংরক্ষণ।

B. গবেষণা ও পাঠদান

•             গবেষণা সহায়তা: গবেষকদের জন্য ঐতিহাসিক নথি ও ডকুমেন্টেশন সরবরাহ করা।

•             শিক্ষামূলক কার্যক্রম: সেমিনার, কর্মশালা, প্রদর্শনী ইত্যাদির আয়োজন।

C. ডিজিটাইজেশন প্রকল্প

•             নথির ডিজিটাইজেশন: নথি সংরক্ষণ এবং ডিজিটাল আর্কাইভ নির্মাণ।

•             অর্জন: বিভিন্ন ঐতিহাসিক নথি ডিজিটাইজ করে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রদর্শন।

D. সংরক্ষণ ও সংকলন

•             ঐতিহাসিক নথি সংরক্ষণ: প্রাচীন দলিল, মুদ্রা, ও অন্যান্য ঐতিহাসিক নথির সংরক্ষণ।

•             নথির পুনঃপ্রকাশ: পুরানো নথি পুনঃপ্রকাশ এবং প্রকাশনার কাজ।

৫. জাতীয় মহাফেজখানার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

A. ডিজিটাল মিউজিয়াম

•             ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নথি প্রদর্শন এবং আন্তর্জাতিক শ্রোতার জন্য সম্প্রসারণ।

B. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

•             বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা: অন্যান্য দেশের আর্কাইভস ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সহযোগিতার জন্য উদ্যোগ।

C. সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্ক

•             সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ: জনগণের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি।

৬. ভারতের জাতীয় মহাফেজখানার ইতিহাসের সারাংশ

পর্যায়       ইতিহাস  অবস্থান ও প্রধান কার্যক্রম  মূল বৈশিষ্ট্য

ঔপনিবেশিক যুগ  ১৮৮৬ সালে কলকাতায় The Imperial Record Room প্রতিষ্ঠা।             কলকাতা, প্রাথমিক নথিপত্র সংরক্ষণ                ব্রিটিশ সরকারের নথিপত্র সংরক্ষণ

প্রথম আধুনিক যুগ               ১৯৩৭ সালে National Archives of India নামে পুনঃনামকরণ। দিল্লি, আধুনিকীকরণ এবং নথিপত্র সংগ্রহ                নতুন ভবন নির্মাণ, আধুনিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা

স্বাধীনতার পর     ১৯৪৭ সালের পর স্বাধীন ভারতের ইতিহাসের নথিপত্র সংরক্ষণ ও আধুনিকীকরণ।  দিল্লি, আধুনিক প্রযুক্তি ও নতুন উদ্যোগ                ডিজিটাইজেশন, গবেষণা সহায়তা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

বর্তমান ও ভবিষ্যৎ              আধুনিক প্রযুক্তি, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ।           দিল্লি, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও নতুন পরিকল্পনা              ডিজিটাল মিউজিয়াম, গবেষণা ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম

উপসংহার

ভারতের জাতীয় মহাফেজখানা ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, যা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের প্রাথমিক উদ্যোগ থেকে শুরু করে স্বাধীন ভারতের আধুনিক এবং প্রযুক্তিনির্ভর সংগ্রহশালা পর্যন্ত একটি বিশাল যাত্রার প্রতিফলন। এর মাধ্যমে ভারতীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি, ও প্রশাসনিক নথিপত্র সংরক্ষণ ও গবেষণার ক্ষেত্রে একটি সুদৃঢ় ভিত্তি গড়ে তোলা হয়েছে।