অথবা, প্রাচীন প্রস্তর যুগের জীবনযাত্রার মান কেমন ছিল, তা আলোচনা করো।
অথবা, ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীন প্রস্তর যুগ সম্বন্ধে যা জানো লেখো।
মানব সংস্কৃতির সর্বপ্রাচীন পর্ব অর্থাৎ প্রাচীন প্রস্তর যুগ হল জৈবিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের আদিতম অধ্যায়। ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে এই যুগের সূচনা হয়েছিল আনুমানিক 2,50,000 বছর পূর্বে এবং শেষ হয়েছিল 10,000 খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এই প্রাচীন প্রস্তর যুগের সময়কাল এত বিশাল যে, এই যুগের পাথরের তৈরি হাতিয়ারের বৈশিষ্ট্য লক্ষ করে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ এই যুগকে নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ এই তিনটি যুগে বিভক্ত করেছেন। অন্যদিক থেকে প্রাচীন প্রস্তর যুগকে ‘খাদ্য সংগ্রহকারীদের যুগ’ বলা হয়, কারণ তখনও অবধি তারা খাদ্য উৎপাদন করতে শেখেনি।
প্রাচীন প্রস্তর যুগে ভারতে হোমো হাবিলিস বা ‘প্রায় মানুষ’ নামে এক জীবের উদ্ভব হয়। এই যুগেই মানুষের বিবর্তন ঘটে হোমো হাবিলিস থেকে হোমো ইরেকটাসে এবং এই যুগের শেষের দিকে হোমো স্যাপিয়েন্স-এ বা আধুনিক মানবে বিবর্তিত হয়েছিল। খুব সম্ভবত আজ থেকে 36,000 বছর আগে।
ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষের নিদর্শন পাওয়া গেছে, যথা-পঞ্জাব, রাজপুতানা, গুজরাট, কর্ণাটক, মহীশূর, মাদ্রাজ, বিহার, অসম, বাংলা প্রভৃতি স্থানে। কাশ্মীরের সোয়ান উপত্যকায় এই যুগের কিছু হাতিয়ার পাওয়া গেছে, যেগুলি তৈরি হয়েছিল শক্ত কোয়ার্টজ জাতীয় স্বচ্ছ পাথর দিয়ে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা জানিয়েছেন মানববিবর্তনের একটি স্তরে হোমো হাবিলিস ও হোমো ইরেকটাস নামক মানুষ এসব অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করেছিল।
প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ প্রথম যে অস্ত্র বানিয়েছিল, তা ছিল হাত-কুঠার ও কাটারি। পাথর দিয়ে অতি পরিশ্রমে তারা কুঠারের হাতল বানিয়েছিল, এজন্য একে বলা হয় প্রধান হাতিয়ার। এগুলি অবশ্য ছিল বেশ ভারী ও অমসৃণ। কাটারি ও হালকা কুঠার পাওয়া গেছে কাশ্মীরের পহেলগাঁও অঞ্চলে, যেগুলিকে ইউরোপীয় প্রত্নতত্ত্ববিদগণ প্রাচীন প্রস্তর যুগের ‘আকিউলিয়ান স্তর’ বা ‘প্রথম পর্ব’ বলে গণ্য করেছেন। এই রকম আরও হাতিয়ার পাওয়া গেছে কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, রাজস্থান ও মহারাষ্ট্রে, যেগুলির বয়স আজ থেকে 1,30,000 বছর পূর্বেকার। এসবের মতো নরকঙ্কাল পাওয়া গেছে নর্মদা উপত্যকায়। অর্থাৎ, এই প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ উপমহাদেশের প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল।
প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষজন প্রধানত ছিল পশুশিকারি ও খাদ্য সংগ্রাহক। তারা খাদ্য উৎপাদন করতে শেখেনি। বন্য পশুকে পোষ মানানোর কৌশল তারা আয়ত্ত করতে পারেনি। জীবনধারণের উপায় ছিল পশুশিকার করা এবং অরণ্য থেকে ফলমূল সংগ্রহ করা। এ যুগের মানুষ কোনো স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করত না, যাযাবরের মতো জীবনযাপন করত। এক স্থানে ফলমূল, পশুশিকারের অভাব হলেই তারা অন্য স্থানে চলে যেত। এ যুগের মানুষ বাসস্থান বানাতে শেখেনি, সাধারণত তারা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিত, এগুলি ছিল তাদের অস্থায়ী বাসস্থান। অনেকসময় এরা খোলা আকাশের নীচে পড়ে থাকত। প্রত্নতত্ত্ববিদরা অস্ত্রপ্রদেশের কুরনলে আদি মানুষের আশ্রয়ের জন্য গুহা খুঁজে পেয়েছেন। উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের সাংঘা এবং ভোপালের কাছে ভীমবেটকায় এই ধরনের মানুষ বসবাসকারী আরও গুহার সন্ধান মিলেছে। প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষজন ভারী ও ভোঁতা পাথরের হাতিয়ার নিয়ে তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করত। ভীমবেটকা থেকে অনেকগুলি গুহাচিত্র পাওয়া গেছে। এগুলি থেকে নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে বিবর্তনের এই পর্বে মানুষের শিকারকে আশ্রয় করে বেঁচেছিল। দেওয়ালের গায়ে তারা শিকারের দৃশ্য এঁকে রাখত। ভালো শিকার পাওয়ার আশায় তারা হয়তো জাদুবিদ্যার সাহায্য নিত, হয়তো কিছু আচার-আচরণ ও অনুষ্ঠানও এই জন্য গড়ে উঠেছিল। তবে মানুষের জীবন ছিল অনিশ্চিত এবং তারা ছিল স্বপ্নায়ু।