মধ্যপ্রস্তর যুগের সংস্কৃতি বলতে বোঝায়, এই সংস্কৃতি পুরোনো প্রস্তর যুগের পরবর্তী এবং নব্যপ্রস্তর যুগের পূর্ববর্তী। ভূস্তর বিন্যাসের পর্যায়ক্রমই এই ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এই যুগের সময়কাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 4000 থেকে খ্রিস্টপূর্ব 2000 অব্দ পর্যন্ত। এই সময়ে তুষারযুগের অবসানের ফলে উত্তরণের এক অন্তবর্তী পরিবর্তনশীল অধ্যায় সূচিত হয়। ভূপৃষ্ঠে আবার দেখা দেয় বন-বনানী ও নানান নতুন জীবজন্তু। এর ফলশ্রুতিরূপে হাতিয়ারগুলিও বদলে যায়। এইচ ডি সাক্কালিয়া 1977 সালে লিখেছেন- ‘ভারতের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রস্তর যুগ হল একটি সাংস্কৃতিক অধ্যায়’ যার প্রকাশ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাতিয়ার, মৃৎপাত্রবিহীনতা ও আদি কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়।
মধ্যপ্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য:
• মধ্যপ্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যপ্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য কতকগুলি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। সেগুলি হল-
স্থান ও বিস্তৃতি:
ছোটোনাগপুর, মধ্য ভারত ও কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণে এই যুগের নানান নিদর্শন পাওয়া গেছে। তবে এই যুগের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হল গুজরাটের লাংঘনাজ। এখানে পাথরের তৈরি অস্ত্রফলক ও তিরের ফলা আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ছাড়া এই যুগের জনবসতিগুলি হল-রাজস্থানের ভিলওয়াড়া জেলার বাগোর ও বুধপুষ্কর; মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকা, আদমগড়ের গুহাবাস; উত্তরপ্রদেশের সরাই নাহার রাই, চোপানি, মানডো; পশ্চিমবঙ্গের বীরভানপুর, কর্ণটিকের সঙ্গোনাকাল্লু এবং তামিলনাড়ুর তিন্নেভেলি; বিহারের পাটনা, ভাগলপুর, সিংভূম, মুঙ্গের; মহারাষ্ট্রের আহমদনগর জেলার নেভাসা, গোদাবরী উপত্যকায় সুরেগাঁও, কালেগাঁও, পুনার শিকারপুরে, অস্ত্রপ্রদেশের রামতীর্থম পাহাড়, গুন্টুরের নাগার্জুনকোন্ড প্রভৃতি স্থানে মধ্যপ্রস্তর যুগের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এই যুগের সংস্কৃতি সম্বন্ধে জানা গেছে।
প্রযুক্তির অগ্রগতি:
মধ্যপ্রস্তর যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল 1 থেকে 3 সেমি লম্বা ক্ষুদ্র পাথরের হাতিয়ার তৈরি ও তা ব্যবহার করা। চাপ পদ্ধতিতে ক্ষুদ্র ফলা তৈরি হত, যা থেকে ত্রিভুজাকৃতি, অর্ধচন্দ্রাকৃতি, ট্রাপিজ আকৃতির আয়ুধ ও তুরপুনের ফলা প্রভৃতি প্রধান হাতিয়ার তৈরি করা হত। তিরজাতীয় হাতিয়ারগুলি ফলা হিসেবে লাগানো হত বাঁশের বা কাঠের সরু লাঠির মাধ্যমে। এই যুগের হাতিয়ারের আরও একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ফ্লেক শিল্পের আধিক্য। ফ্লেক বা পাতের অস্ত্রগুলি ছিল আগের তুলনায় পাতলা ও হালকা।
জীবিকা ও অর্থনীতি:
মধ্যপ্রস্তর যুগের মানুষের চাষের কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে বুনো শস্য যে সংগৃহীত হত সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। কারণ পেষাই, বাটনা প্রভৃতি কাজে ব্যবহৃত আয়ুধের উপস্থিতিই তার প্রমাণ। উত্তরপ্রদেশের সরাই নাহার রাই প্রত্নকেন্দ্রে জাঁতা ও হামানদিস্তা আবিষ্কৃত হয়েছে। নর্মদা উপত্যকার আদমগড় প্রত্নকেন্দ্র থেকে 2500 মাইক্রোলিথ, কুকুর, গোরু-বাছুর, মোষ, ভেড়া, শূকর, ছাগল প্রভৃতি গৃহপালিত পশুর পরিচয় পাওয়া গেছে। উত্তরপ্রদেশের দমদমা প্রভৃতি কেন্দ্র থেকে কঙ্কালসহ কবরের সন্ধান পাওয়া গেছে, যা থেকে বোঝা যায় কবরগুলি ছিল ডিম্বাকৃতি। মৃতের শরীরে হাড় দিয়ে তৈরি গয়না, ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও পোষ্য প্রাণীকেও কবর দেওয়া হত। এ থেকে বোঝা যায়, মৃত্যু-পরবর্তী জীবনকে মানুষ বিশ্বাস করত। এই যুগের মানুষ সংগৃহীত বন্য শস্যদানা, ফলমূলের পাশাপাশি গোরু, ছাগল, ভেড়া, হরিণ, শুকর মাংস খেত। বাগোরে মাংস কাটার বেদিও আবিষ্কৃত হয়েছে। অর্থাৎ, এই যুগের অর্থনীতি পশুশিকার এবং পশুকে পোষ মানানো পর্যন্ত পৌঁছেছিল।
শিল্প:
মধ্যপ্রস্তর যুগের মানুষ জীবিকার জন্য ও কিছুটা মানসিক পরিতৃপ্তি লাভের জন্য বেশ কিছু শিল্পকর্ম রেখে গেছে, যা প্রকাশ পেয়েছে তাদের তৈরি হাতিয়ার ও চিত্রকলা, বিশেষত গুহাচিত্রের মাধ্যমে। ভীমবেটকায় প্রাপ্ত (খ্রিস্টপূর্ব 6000 পর্যন্ত) গুহাচিত্রগুলি আমাদের বিস্ময়ের উদ্রেক করে। একটি চিত্রে দেখা যায় শিকারিরা তিরধনুক নিয়ে পশুশিকার করছে। আরও একটি ছবিতে দেখা যায়, মাথায় বোঝা নিয়ে দাঁড়ানো এক নারীকে। আর একটিতে রেখার টানে আঁকা একটি ময়ূরীর চিত্র পাওয়া গেছে, যা ছিল শিল্পদক্ষতার এক অদ্ভুতপূর্ব নিদর্শন। লাখাজোয়ার-এ সবুজ রঙে আঁকা একটি নাচের দৃশ্য আমাদের নজর কাড়ে। এখানে অবশ্য মনে রাখা দরকার যে, মধ্যপ্রস্তর যুগের চিত্রকলার ধারা মুখ্যত জ্যামিতিক ধারায় করা এবং প্রারম্ভিক পর্যায়ে হলুদ, সবুজ, লাল প্রভৃতি রং ব্যবহৃত হয়েছে। ছাড়া এই যুগের পশ্চিমবঙ্গের লালজলের শৈলচিত্র, ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগ জেলার শৈলচিত্র, কাশ্মীর মির্জাপুরের শৈলচিত্র এবং পাঁচমাড়ির শৈলচিত্র উল্লেখযোগ্য।
পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতের মধ্যপ্রস্তর যুগের মানুষ প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও বিশেষ করে শিল্পকলা তথা গুহাচিত্রের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাপ রেখে গেছে। এই যুগের অগ্রগতির ওপর দাঁড়িয়ে নব্যপ্রস্তর যুগের ও ধাতুর যুগের মানুষ আরও বেশি উন্নতি ঘটাতে পেরেছিল, এখানেই মধ্যপ্রস্তর যুগের গুরুত্ব নিহিত রয়েছে।