শিক্ষা ও শিক্ষা-মনোবিদ্যার মধ্যে পার্থক্য:
শিক্ষার সঙ্গে মনোবিদ্যার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার অন্যতম ভিত্তি হল মনোবিদ্যা। শিক্ষার সঙ্গে মনোবিদ্যার এই সম্পর্ককে ভিত্তি করে শিক্ষা-মনোবিদ্যা একটি পৃথক জ্ঞানের বিষয় বলে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু এ কথা মনে করলে ভুল হবে যে শিক্ষা ও মনোবিদ্যা এক। শিক্ষা ও মনোবিদ্যার মধ্যে কতকগুলি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্যগুলি নিম্নে উল্লেখ করা হল-
প্রথমত, মনোবিজ্ঞান বিষয়নিষ্ঠ বিজ্ঞান। অপরদিকে শিক্ষা নিয়মনিষ্ঠ বিজ্ঞান।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষা কেবল মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, শিক্ষা দর্শন, সমাজ ও অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত।
তৃতীয়ত, মনোবিজ্ঞান একটি মৌলিক বিজ্ঞান, সেই অর্থে শিক্ষা মৌলিক বিজ্ঞান নয়। দর্শন, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি প্রভৃতি সব নিয়েই শিক্ষাবিজ্ঞান।
চতুর্থত, মনোবিজ্ঞান আচরণ বিশ্লেষণ, আচরণ সম্পৰ্কীয় তথ্য ও নীতি আবিষ্কার এবং আচরণের নিয়ন্ত্রণ কৌশল সম্পর্কে অধ্যয়ন করে। অপরদিকে শিক্ষা আচরণ সম্পর্কীয় তত্ত্ব, নীতি, কৌশল ইত্যাদি শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগ করে এবং শিক্ষা শিখনকে কার্যকারী করে তোলে। এই অর্থে মনোবিজ্ঞান হল শুদ্ধ বিজ্ঞান এবং শিক্ষা হল প্রয়োগিক বিজ্ঞান।
পঞ্চমত, দেশ, সমাজ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি ভেদে শিক্ষার লক্ষ্য, পাঠক্রম কর্মসূচি সবেরই পরিবর্তন দেখা যায়। মনোবিজ্ঞান স্থান, সমাজ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি নিরপেক্ষ।
কৈশোর কালকে কেন ঝড় ঝঞ্ঝার কাল বলা হয়?
বাল্যকাল ও প্রাপ্তবয়স্ককালের মধ্যবর্তী সময়কালকে বয়সন্ধিকাল বা কৈশোর কাল বলে। কৈশোরকাল অতিক্রম করে কিশোর কিশোরীরা পূর্ণ বয়সের দিকে এগিয়ে যায়। তাই তাদের আচরণ শিশুশুলভও হয় না, আবার পূর্ণ ব্যক্তির মতোও হয় না। আবার যেহেতু শারীরিক, মানসিক, প্রাক্ষোভিক, বৌদ্ধিক, সামাজিক ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন এই বয়সে দেখা যায়। সেহেতু হঠাৎ করে আগত এই পরিবর্তন তারা সহজে মেনে নিতে পারে না। তাই তাদের জীবন তখন ঝড়সদৃশ হয়ে যায়। অর্থাৎ এক জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তারা এগিয়ে চলে।
‘বৈপ্লবিক পরিবর্তনের স্তর’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন । আবার কোন কোন মনোবিজ্ঞানী ‘ক্রমবিকাশমূলক স্তর’ বলে ব্যক্ত করেছেন। কিশোর- কিশোরীদের জীবনে এই সংকটময়তার জন্য নানান সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাই মনোবিদ জি এস হল একে ‘ঝড়ঝঞ্ঝার ও দুঃখ কষ্টের কাল’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
ঝড় ঝঞ্ঝারকাল বলার কারণ:- সাধারণত ১২ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সময়কালকে কৈশোর কাল বলা হয়। এই সময়কালকে মনোবিদ জি এস হল ‘ঝড়ঝঞ্ঝার ও দুঃখ কষ্টের কাল’ কাল বলেছেন। এরূপ মন্তব্যের কারণগুলি হলো:- যৌন চেতনা অবদমন:- কৈশোরকালে ছেলেমেয়েদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে যৌন চেতনা দেখা যায়। কিন্তু আকস্মিক পরিবর্তন সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা ও সামাজিক সমর্থনের অভাবে কিশোর কিশোরীরা যৌন চেতনাকে অবদমন করতে বাধ্য হয় । ফলে তারা মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে।
পাপবোধ:- কিশোর-কিশোরীরা এই বয়সে যৌনতা সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করে। কিন্তু এই সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর না পাওয়ায় ও যৌনতা সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণার ফলে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং অন্যায় বোধ জাগরিত হয় এবং অনেক সময় তারা পাপবোধ করে।
সংগতি বিধানজনিত সমস্যা:- বয়:সন্ধিকালের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল সঙ্গতি বিধানজনিত সমস্যা। নতুন পরিস্থিতিতে সংগতিবিধানে কিশোর-কিশোরীদের অনেক সময় অসুবিধা হয়। কারণ যুক্তি, চিন্তন, বিচারবোধ, দায়িত্ব-কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতনতা ইত্যাদি এই বয়সের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
বাধাপ্রাপ্ত:- কিশোর-কিশোরীরা এই বয়সে যে কোনো নতুন কাজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে অথবা পরিবারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে এই বয়সের ছেলে মেয়েরা মতামত দিতে চাইলে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা তাদের বাধা দেন। ফলে সে নিজেকে মূল্যহীন ভাবতে শুরু করে।
হীনম্মন্যতা সৃষ্টি :- নতুন পরিবেশে বা সকলের সামনে যদি কিশোর কিশোরীদের অপদস্থ, অসম্মান বা অপমান করা হয়, তবে তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতা সৃষ্টি হয় এবং এই লক্ষণগুলি কিশোর কিশোরীদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথে বাধা
পরিশেষে বলা যেতে পারে যে, ঝড় যেমন সুন্দরভাবে সাজানো প্রকৃতিকে এলোমেলো ও অবিন্যস্ত করে দেয়। ঠিক তেমনিভাবেই বয়:সন্ধিকালের আকস্মিক পরিবর্তনগুলি কৈশোরের নিষ্পাপ সুন্দর জীবনকে অগোছালো, এলোমেলো করে দেয়। তাই এই বয়সের ছেলেমেয়েদের ভাবনা-চিন্তা কল্পনা যুক্তি ইত্যাদি সমস্ত কিছুই অর্থহীন মূল্যহীন মনে হয়। তখনই সংকটময় সমস্যামূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তাই বয়:সন্ধিকাল বা কৈশোরকালকে অনেক মনোবিজ্ঞানী “ঝড়ঝঞ্ঝা বা পীড়ন-কষ্টের কাল” বলে উল্লেখ করেছেন।