মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কে?
মালাধর বসুর রচিত ভাগবত কৃত্তিবাসীর রামায়ণ বা কাশীদাসী মহাভারত এর মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি, এর কিছু কারণ রয়েছে যা তাঁর কবি প্রতিভা এবং সময়ের প্রেক্ষাপটে বোঝা যায়।
১. কাব্যরূপের বিশালতা ও গভীরতা
মালাধর বসুর ভাগবত অত্যন্ত গভীর আধ্যাত্মিক ও দর্শনমূলক কাব্য। এটি ছিল বিশাল আঙ্গিকের ধর্মীয় ও দার্শনিক কাব্য, যা সাধক ও আধ্যাত্মিক দর্শনের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত। কৃত্তিবাসীর রামায়ণ বা কাশীদাসী মহাভারতের মতো সাধারণ জনগণের কাছে সহজবোধ্য, প্রাঞ্জল এবং কাহিনির মাধ্যমে জীবন ও নৈতিকতার শিক্ষা প্রদানকারী কাব্য ছিল না। মালাধরের ভাগবত এর দার্শনিক চেতনা এবং আধ্যাত্মিক আলোচনায় বিশেষ শ্রেণির মানুষের প্রতি লক্ষ্য ছিল, যা সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছানো কঠিন ছিল।
২. ভাষার জটিলতা এবং উচ্চতা
মালাধর বসু তাঁর কাব্য রচনা করেছেন প্রাচীন সংস্কৃত শাস্ত্রীয় ধারায়, যার মধ্যে বেশ কিছু কঠিন এবং তাত্ত্বিক ভাষার ব্যবহার ছিল। তাঁর ভাষার গভীরতা এবং শাস্ত্রীয় শব্দাবলীর ব্যবহার সাধারণ পাঠকদের জন্য কঠিন হতে পারে, এবং এই কারণে কাব্যটি সাধারণ মানুষের কাছে সহজভাবে জনপ্রিয় হতে পারেনি। কৃত্তিবাসী বা কাশীদাসী মহাভারত ছিল অনেক বেশি সহজ ভাষায় রচিত, যা সাধারণ মানুষ সহজেই গ্রহণ করতে পারত।
৩. প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ
কৃত্তিবাসী রামায়ণ এবং কাশীদাসী মহাভারত রচনার সময় বাংলা সাহিত্যে এই ধরনের মহাকাব্যিক কাহিনির চাহিদা ব্যাপক ছিল। বিশেষ করে কাশীদাসী মহাভারত মধুপুরাণের ন্যায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, কারণ এটি জনগণের মনস্তত্ত্ব এবং দৈনন্দিন জীবনের সাথে সম্পর্কিত কাহিনির মাধ্যমে সমাজে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। এর বিপরীতে, মালাধরের ভাগবত ছিল শাস্ত্রীয় ও আধ্যাত্মিক মানদণ্ডের অনুসরণকারী, যা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাথে তেমন সম্পর্কিত ছিল না।
৪. সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও যুগের পরিবেশ
মালাধর বসুর রচিত ভাগবত পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও আধ্যাত্মিক সাহিত্য ছিল, যা তখনকার সাধারণ জনগণের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক চাহিদার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ ছিল না। বাংলার সাহিত্যে ভক্তির এবং পুরাণ কাহিনির প্রবণতা তখনও গড়ে ওঠেনি, যেমনটা কৃত্তিবাসী বা কাশীদাসী মহাভারতে ছিল। তখনকার মানুষ ধর্মীয়, কাহিনির প্রতি আগ্রহী ছিল, কিন্তু মালাধরের কাব্য অধিকাংশ দর্শনশাস্ত্রের প্রতি মনোযোগী, যা একেবারেই অন্য ধরনের পাঠকপ্রত্যাশী ছিল।
৫. ঐতিহ্যের অবদান
কৃত্তিবাসী রামায়ণ এবং কাশীদাসী মহাভারত বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত একটি ঐতিহ্য। তাদের কাহিনির মধ্য দিয়ে নৈতিক শিক্ষা ও দেবদেবীর পূজা মানুষের মনের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। মালাধর বসুর ভাগবত, যদিও তার সময়ের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক কাজ ছিল, কিন্তু এটি সেই রকম ঐতিহ্য তৈরি করতে পারেনি যেহেতু এটি ছিল বেশিরভাগ ভক্তিমূলক এবং আধ্যাত্মিক এবং খুব কম মানুষের জন্য তা সমর্থনযোগ্য।
উপসংহার:
মালাধর বসুর ভাগবত কাব্য কৃত্তিবাসী রামায়ণ বা কাশীদাসী মহাভারতের মতো জনপ্রিয় হয়নি কারণ এটি অনেক বেশি দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক চিন্তাধারার প্রতি নিবেদিত ছিল, যা সাধারণ মানুষের কাছে সহজে পৌঁছায়নি। ভাষার কঠিনতা, কাব্যের আঙ্গিক এবং প্রতিযোগিতার কারণে এই কাব্যটি সেই সময়ের প্রচলিত সাহিত্যিক ধারায় সেভাবে ছড়িয়ে পড়েনি।