কলাবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্ত ছন্দের স্বরূপ বৈশিষ্ট্য উদাহরণসহ আলোচনা করো।

অথবা, প্রত্নকলাবৃত্ত কাকে বলে? তার স্বরূপ বৈশিষ্ট্য উদাহরণসহ লেখো।

মাত্রাবৃত্ত ছন্দ:


মাত্রাবৃত্তের ক্রিয়া কলাপ অনেকটা স্বরবৃত্তের মতো হলেও এই ছন্দে বদ্ধস্বর দু’মাত্রা বহন করে। কোনো অবস্থাতেই বদ্ধস্বর একমাত্রা বহন করতে পারে না। কিন্তু স্বরবৃত্তের মতোই মুক্তস্বরের মাত্রা এক।
কবিতার পঙ্ক্তি দিয়ে বিবেচনা করা যায়।

১. মামার বাড়িতে/ যাবো না গো আমি/ খাবো না গো আর/ মামীর গাল,
কথায় কথায়/ পড়বে না আর/ পিঠের উপরে/ অমন তাল।

এখানে স্বরবৃত্ত ছন্দের প্রথম উদাহরণটি একটু ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি লাইনে এবার ছয় মাত্রার তিনটি করে পর্ব এবং পাঁচ মাত্রার একটি করে অতিপর্ব এসেছে।

মাত্রা বিন্যাস:
মামার বাড়িতে/ যাবো না গো আমি/ খাবো না গো আর/ মামীর গাল,

কথায় কথায়/ পড়বে না আর/ পিঠের উপরে/ অমন তাল।

অতএব কবিতাটির কাঠামো দাঁড়ায় :

৬ + ৬ + ৬ + ৫

অতিপর্বের মাত্রা সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়, তবে কিছুতেই তা পর্বের মাত্রা সংখ্যার সমান হবে না। অতিপর্বের মাত্রা সংখ্যা যদি পর্বের মাত্রা সংখ্যার সমান হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে অতিপর্ব একটি পূর্ণ পর্বের রূপ নেবে। এখানে বলে রাখা ভালো, অতিপর্ব ছাড়াও শুধু পর্ব দিয়ে কবিতার কাঠামো তৈরি করা যায়। মাত্রা বিন্যাস সহ আরো কিছু কবিতার উদাহরণ:

ছয় মাত্রার পর্ব এবং চার মাত্রার অতিপর্ব:

২. কবি বন্ধুরা/ হতাশ হইয়া/ মোর লেখা পড়ে/ শ্বাস ফেলে

বলে কেজো ক্রমে/ হচ্ছে অকেজো/ পলি টিক্সের/ পাশ ঠেলে।
(আমার কৈফিয়ৎ/ কাজী নজরুল ইসলাম)

কবিতাটির কাঠামো:

৬ + ৬ + ৬ + ৪

ছয় মাত্রার পর্ব এবং তিন মাত্রার অতিপর্ব:

৩. সই পাতালো কি/ শরতে আজিকে/ স্নিগ্ধ আকাশ/ ধরণী ?

নীলিমা বহিয়া/ সওগাত নিয়া/ নমিছে মেঘের/ তরণী !
(রাখী বন্ধন/ কাজী নজরুল ইসলাম)

কাঠামো:

৬ + ৬ + ৬ + ৩

ছয় মাত্রার পর্ব এবং দুই মাত্রার অতিপর্ব:

৪ক. এ জগতে হায়/ সেই বেশি চায়/ আছে যার ভূরি/ ভূরি

রাজার হস্ত/ করে সমস্ত/ কাঙালের ধন/ চুরি।
(দুই বিঘে জমি/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

খ. দুর্গম গিরি/ কান্তার মরু/ দুস্তর পারো/ বার

লঙ্ঘিতে হবে/ রাত্রি নিশিতে/ যাত্রীরা হুশি/ য়ার।
(কাণ্ডারী হুশিয়ার/ কাজী নজরুল ইসলাম)

কাঠামো:

৬ + ৬ + ৬ + ২

পাঁচ মাত্রার পর্ব কিন্তু অতিপর্ব নেই:

৫. তোমারে পাছে/ সহজে বুঝি/ তাই কি এতো/ লীলার ছল/

বাহিরে যবে/ হাসির ছটা/ ভিতরে থাকে/ আখির জল।/
(ছল/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
কাঠামো:

৫ + ৫ + ৫ + ৫

পাঁচ মাত্রার পর্ব এবং দু’মাত্রার অতিপর্ব:

৬ক. এ-ভূজমাঝে/ হাজার রূপ/ বতি

আচম্বিতে/ প্রাসাদ হারা/ য়েছে;

অমরা হতে/ দেবীরা সুধা/ এনে,

গরল নিয়ে/ নরকে চলে/ গেছে।
(নিরুক্তি/ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত)

কাঠামো:

৫ + ৫ + ২

খ. হৃদয়ে তার/ অন্ধকার/ পৃথিবী নিঝ/ ঝুম

বিফল তার/ সকল বৈ/ভব

ভাঙে না তার/ বসন্তের/ অন্তহীন/ ঘুম

জাগে না কল রব/

কপালে যার/ আঁকেনি কেউ/ প্রেমের কুম/ কুম

ব্যর্থ তার/ সব।
(মধ্য ফাল্গুনে/নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)

কাঠামো:

৫ + ৫ + ৫ + ২
৫ + ৫ + ২

গ. তখনো ছিলো/ অন্ধকার/ তখনো ছিলো/ বেলা

হৃদয় পুরে/ জটিলতার/ চলিতেছিলো/ খেলা

ডুবিয়াছিলো/ নদীর ধার/ আকাশে আধো/ লীন

সুষমাময়ী/ চন্দ্রমার/ নয়ান ক্ষমা/ হীন
(হৃদয়পুর/শক্তি চট্টোপাধ্যায়)

কাঠামো:

৫ + ৫ + ৫ + ২

আট মাত্রার পর্ব এবং ছয় মাত্রার অতিপর্ব:

৭. শেফালি কহিল আমি/ ঝরিলাম তারা !

তারা কহে আমারো তো/ হল কাজ সারা।
(এক পরিণাম/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

কাঠামো:
৮ + ৬

এখানে বলে রাখা ভালো এ কাঠামোর কবিতাকে আট-ছয় মাত্রার কবিতাও বলা যেতে পারে। চৌদ্দ মাত্রার সনেট সৃষ্টির কাজে এ ধরনের ছন্দ বিন্যাস বিশেষ ব্যবস্থায় কাজে লাগানো যায়। তাছাড়া অক্ষরবৃত্ত ছন্দে এর উপস্থিতি অনেক বেশি।

মাত্রাবৃত্তে সাত মাত্রার পর্বের ব্যবহার বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অনেকটা স্বরবৃত্তের মতোই তবে মাত্রাবৃত্তে অতিপর্ব রাখাটা বেশ সহজতর। প্রথমে অতিপর্বহীন কয়েকটি কবিতার উদাহরণের দিকে তাকানো যাক।

সাত মাত্রার দুই পর্ব বিশিষ্ট কবিতা:

৮. তোমার মুখ আঁকা/ একটি দস্তায়/

লুটিয়ে দিতে পারি/ পিতার তরবারি/

বাগান জোত জমি/ সহজে সস্তায়/

তোমার মুখ আঁকা/ একটি দস্তায়;/
(শোণিতে সৌরভ/ আল মাহমুদ)
কাঠামো:

৭ + ৭

সাত মাত্রার তিন পর্ব বিশিষ্ট কবিতা:

৮. উগ্র ঢাল, তার/ তীক্ষè শরমুখ/ রঙিন, কোপনীয়/

রেখেছে সঞ্চিত/ যা-কিছু মায়াময়,/ মধুর, গোপনীয়
(সুন্দর জাহাজ/অনু: বুদ্ধদেব বসু)

কাঠামো:
৭ + ৭ + ৭

সাত মাত্রার চার পর্ব বিশিষ্ট কবিতা:

৯.
অন্ধ রেল গাড়ি/ বধির রেলগাড়ি/ অন্ধ রেল বেয়ে/ চলছে দ্রুত বেগে/

দু-চোখে মরা ঘুম/ আকাশে মরা মেঘ/ সঙ্গে মরা চাঁদ/ অন্ধ আছি জেগে/

অন্ধ বগিগুলো/ ক্লান্ত হয়ে গেছে/ এগিয়ে চলে তবু/ অন্ধ প্রতিযোগী/

চলছে ট্রাগ বেয়ে/ জানে না কোথা যাবে/ নষ্ট রেলগাড়ি/ অন্ধদূর বোগী।/
(অন্ধ রেলগাড়ি / হুমায়ুন আজাদ)

কাঠামো:

৭ + ৭ + ৭ + ৭

সাত মাত্রার মাত্রাবৃত্তে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার অতিপর্ব ব্যবহারের নমুনা:

১০. ফসল অন্যের,/ তোমার শুধু
অন্য কোনো দূর/ অরণ্যের
পন্থহীনতায়/ স্বপ্নে কেঁপে ওঠা/
কোন অসম্ভব/ আকাক্সক্ষায়।
(অসম্ভবের গান/বুদ্ধদেব বসু)

কাঠামো:
৭ + ৫
৭ + ৫
৭ + ৭
৭ + ৬

এই চার লাইনে অতিপর্বে কোথাও পাঁচ কোথাও ছয় মাত্রা রাখা হয়েছে। কিন্তু তৃতীয় লাইনে কোনো অতিপর্ব নেই। ফলে, তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন মিলে একটি পঙ্ক্তি তৈরী করেছে।

১১. নিমেষে ভুলি সাধ/ অতল মোহে।
মোহিনী ও-মুখের/ মিথ্যা বুলি
সত্য সার ভাবি,/ এবং আমি
ধারি না ধার কোনো/ মহোদয়ের।
(কবর খোড়ার গান/শামসুর রাহমান)

কাঠামো:
৭ + ৫
৭ + ৫

এই কবিতায় পাঁচ মাত্রার অতিপর্ব রাখা হয়েছে।

১২. যেখানে লেজবস/ প্রণয় ঝর্ণায়/ উলঙ্গ
শান্ত বয়ে যায়/ গভীর শেষমেশ/ সমুদ্রে
ভাসিয়ে প্রান্তর/ যায় সে আঁকাবাঁকা/ খলখল
ঝঞ্ঝা গোপনীয়,/ দেবতা ভূমিতলে/ অসংখ্য
যেখানে লেজবস/ প্রণয় ঝর্ণায়/ উলঙ্গ।
(লেসবস/অনু: হাসানআল আব্দুল্লাহ)

কাঠামো:
৭ + ৭ + ৪
৭ + ৭ + ৪

বোদলেয়ার রচিত এই কবিতাটি অনুবাদে অতিপর্বে চার মাত্রা রাখা হয়েছে। দু’টি করে পর্ব দিয়ে কবিতার লাইন গঠিত।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading