মিলের উপযোগবাদ আলোচনা কর।

নীতিবিদ্যা মানুষের ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত ইত্যাদির পাশা পাশি মানুষের ঐচ্ছিক আচরণ নিয়েও আলোচনা করে। নীতিবিদ্যা এ সব ঐচ্ছিক আচরণের বিস্তারিত মূল্যায়ন করে থাকে। ঐচ্ছিক আচরণের মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজন পড়ে সুখবাদের। সুখবাদ অনুসারে সুখই মানুষের পরম বা প্রধান কাম্য। প্রত্যেক ব্যক্তির সুখ অন্বেষণ করা উচিত। এ সুখবাদের চরম পর্যায়ের আলোচনা হচ্ছে উপযোগবাদ।

মিলের উপযোগবাদের বৈশিষ্ট্য:


১. গুণ সুখের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্যঃ প্রাচীন যুগে এপিকিউরাস সুখের মূল্য নিরূপণের ক্ষেত্রে গুণের ধারণার কথা বলে সুখবাদের স্থূলতাকে অনেকাংশে দূরীভূত করেন। সর্বাধিক পরিমাণ সুখের সঙ্গে এপিকিউরাসের সুখের গুণের ধারণাটি সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না বলে তা পরবর্তীকালে নৈতিকতার চিন্তাধারায় তেমন কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি।

২. সুখের শ্রেণিবিভাগঃ মিল সুখকে ২টি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা- ১. স্থায়ীসুখ ও ২. গতিময় সুখ। স্থায়ী সুখকে তিনি মনের সুখ বলে মনে করেছেন। গতিময় সুখকে তিনি ইন্দ্রিয় সুখ বলে মনে করেন, যা ক্ষণস্থায়ী এবং অতি দ্রুত স্মৃতি থেকে মুছে যায়।

৩. সুখের কাম্যতাঃ মিল মনে করেন মানুষ সর্বদা সুখ কামনা করে এবং সুখের আনুষঙ্গিক কাজগুলো করতে সে দ্বিধারোধ করে না। সুতরাং সুখই একমাত্র কামনার যোগ্য।

৪. সুখের সার্বিকতাঃ উপযোগবাদ সব সময় সুখের সার্বিকতা অর্থাৎ সর্বাধিক পরিমাণ লোকের জন্য সর্বাধিক পরিমাণ সুখ লাভই মানব জীবনের পরম কল্যাণ। সমাজের বৃহত্তর কল্যাণ সাধনের জন্য আমাদের অবশ্যই সার্বিক সুখের দিকে জোর দেওয়া জরুরি।

৫. গুণগত পার্থক্য স্বীকারঃ সুখের দু’টি নীতি হলো গুণগত ও পরিমাণগত। মিল সুখের গুণগত পার্থক্যের কথা স্বীকার করেছেন। তাই বলে তিনি পরিমাণগত পার্থক্যকে এড়িয়ে যাননি। কোনো জিনিসকে বিচার করতে হলে গুণগতও পরিমাণগত উভয় সুখের প্রয়োজন রয়েছে।

৬. সুখের উপস্থিতি ও বেদনার অনুপস্থিতিঃ মিল মনে করেন মানুষ সব সময় সুখ অন্বেষণ করে এবং দুঃখকে পরিহার করতে চায়। সুখ আবার স্থায়ী ও গতিময় ইত্যাদি শ্রেণির হতে পারে। অধিকাংশ মানুষ স্থায়ী সুখ পেতে চায়।

৭. সুখ পরিমাপযোগ্যঃ মিল মনে করেন সুখকে স্থিতিকাল ও তীব্রতা ইত্যাদির ভিত্তিতে পরিমাপ করা যায়। যেমন তৃষ্ণা পেলে আমরা পানি পান করার ফলে আনন্দ লাভ করি।

. নিয়ন্ত্রণের প্রাধান্যঃ মিল সুখের পরিমাণ নির্ণয় করার জন্য কয়েকটি নিয়ন্ত্রণের কথা স্বীকার করেন। যেমন ধর্মীয়, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ইত্যাদি।

৯. বিচারকের রায়ঃ সুখের মূল্য নিরূপণ করতে গিয়ে মিল বিচারকের রায়ের উপর নির্ভর করেছেন। সমাজের গণ্যমান্য লোকসমূহের বিচারের রায়ের মাধ্যমে সুখের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়।

১০. মানুষ উচ্চতর বৃত্তির অধিকারীঃ মিল মনে করেন যে, মানুষের মধ্যে একটা উচ্চতর বৃত্তি রয়েছে। নিম্নতর বৃত্তি অপেক্ষা উচ্চতর বৃত্তিতে যদিও সুখ কম তথাপি তা ভালো। এই উচ্চতর বৃত্তিই মানুষকে পশু থেকে আলাদা করে।

মিলের উপযোগবাদ বেন্থামের উপযোগবাদ থেকে উন্নতঃ জন স্টুয়ার্ট মিলকে উপযোগবাদের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তার উপযোগবাদের ভিত্তি হলো মনস্তাত্ত্বিক সুখবাদ। তিনি সর্ববাদি সুখবাদ অর্থাৎ সর্বাধিক সংখ্যক লোকের জন্য সর্বাধিক পরিমাণ সুখের কথা বলেছেন। জেরেমী বেন্থামের উপযোগবাদের ত্রুটি বিচ্যুতি দূর করে বলেছেন যে, সমাজের সব মানুষের সুখ বাস্তবায়ন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সুখের যে দু’টি দিক আছে অর্থাৎ গুণগত দিক ও পরিমাণগত দিক; এক্ষেত্রে তিনি গুণগত দিকের কথা বেশি করে প্রচার বা স্বীকার করেছেন। মিল এ প্রসঙ্গে বলেছেন যে, মানুষের শুধু পরিমাণগত সুখ অন্বেষণ করা উচিত নয়, গুণগত সুখও মানুষের কাম্য হওয়া উচিত। সুতরাং বলা যায় যে, মিলের উপযোগবাদ বেন্থামের উপযোগবাদ থেকে স্বতন্ত্র বা ভিন্ন।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, উপযোগবাদের বিরূদ্ধে যদিও বিভিন্ন আপত্তি বা সমালোচনা উত্থাপিত হয়ে থাকে, তথাপি এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, মিল উপযোগবাদের আলোচনা করতে গিয়ে মানুষের উচ্চতর বৃত্তি ও মর্দাদাবোধের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সুতরাং বলা যায় মিলের উপযোগবাদের গুরুত্ব অপরিসীম।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading