মুকুন্দের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে ‘কালকেতুর ভোজন’ প্রসঙ্গে যে খাদ্য তালিকা বর্ণিত তাতে কবির যে কাব্যসৌন্দর্য ব্যক্ত তা আলোচনা করো।

মুকুন্দের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে ‘কালকেতুর ভোজন’ –

মুকুন্দ চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে ‘কালকেতুর ভোজন’ পর্বটি বাংলা মঙ্গলকাব্যের অন্যতম উজ্জ্বল নিদর্শন। এই অংশে গ্রামীণ সমাজের খাদ্যসংস্কৃতি এবং তার সঙ্গে যুক্ত জীবনের সজীবতা ও সমৃদ্ধি কাব্যিকভাবে প্রকাশ পায়। কবি অত্যন্ত সৃজনশীল ভাষায় বিভিন্ন খাদ্যের বর্ণনা দিয়ে তা পাঠকের মনোজগতকে মুগ্ধ করে তোলেন। এখানে কেবল খাদ্যের বিবরণ নয়, বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এবং আধ্যাত্মিক দিকও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

কালকেতুর ভোজন পর্বের বর্ণনার কাঠামো

‘কালকেতুর ভোজন’ অংশে গ্রামীণ কৃষক কালকেতু ও তার পরিবার বিশাল এক ভোজ উৎসব আয়োজন করেন। এ উৎসবের খাদ্য তালিকা অত্যন্ত সমৃদ্ধ, যা মঙ্গলকাব্যের প্রচলিত শৈলীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কবি খাদ্যের নাম উল্লেখের পাশাপাশি তা পরিবেশনের পদ্ধতি, স্বাদ, এবং ভোজনের আনন্দও কাব্যিকভাবে তুলে ধরেন।

খাদ্য তালিকার বৈচিত্র্য

খাদ্য তালিকায় বিভিন্ন প্রকার ভাত, শাক-সবজি, মাছ-মাংস, এবং মিষ্টান্নের বর্ণনা পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ:

  1. ভাত চাল: ভাতের জন্য কবি উল্লেখ করেছেন ‘আতপ’, ‘সিদ্ধ’ ও ‘গভীর গন্ধযুক্ত চাল’।
  2. শাকসবজি: কলমি, শুষনি, পুঁইশাক, কুমড়ো, এবং বেগুনের কথা বলা হয়েছে।
  3. মাছ: নদীর মাছ যেমন কাতলা, ইলিশ, চিতল, শোল, এবং মাগুরের কথা পাওয়া যায়।
  4. মাংস: খাসি, মুরগি এবং হাঁসের মাংসের বিবরণ রয়েছে।
  5. মিষ্টান্ন: পায়েস, মন্ডা, নারকেলের নাড়ু, এবং ক্ষীরের বর্ণনা পাওয়া যায়।

এই তালিকায় গ্রামীণ সমাজের খাদ্যাভ্যাসের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। কবি বিভিন্ন খাদ্যের নাম এবং তার সঙ্গে যুক্ত অনুভূতিকে এতটাই কাব্যিকভাবে প্রকাশ করেছেন যে, তা শুধু বর্ণনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং জীবনের প্রতি এক ধরণের উদযাপন হয়ে ওঠে।

কাব্যসৌন্দর্যের দিকগুলো

‘কালকেতুর ভোজন’ পর্বে কবির কাব্যিক নৈপুণ্য বিভিন্ন দিক থেকে ফুটে ওঠে।

1. চিত্রকল্প নির্মাণ

কবির বর্ণনায় প্রতিটি খাদ্য একেকটি দৃশ্যের মতো মনে হয়। উদাহরণস্বরূপ, মাছের বর্ণনায় নদীর প্রবাহ ও তার জীবন্ত প্রাণের চিত্র ভেসে ওঠে। শাক-সবজির বর্ণনায় গ্রামীণ প্রকৃতির সজীবতা প্রতিফলিত হয়। মিষ্টান্নের বর্ণনায় উঠে আসে স্নিগ্ধতার আবহ।

2. ধ্বনিতত্ত্বের ব্যবহার

খাদ্যের নামের সঙ্গে জুড়ে থাকা অনুপ্রাস ও ধ্বনিতত্ত্ব কাব্যের সংগীতধর্মিতা বাড়িয়ে তুলেছে। যেমন,

“ইলিশ, চিতল, মাগুর, শোল—
নদীর মাছ রত্নের মতো ঝলমল।”

3. ভাষার সরলতা রসবোধ

বর্ণনায় সরল ও প্রাণবন্ত ভাষার ব্যবহার গ্রামীণ জীবনের সহজিয়া মেজাজকে উপস্থাপন করে। ভোজনের আনন্দ ও উৎসবমুখরতা এমনভাবে ফুটে ওঠে যে, তা রসিকতার আবহ সৃষ্টি করে।

4. প্রতীকধর্মিতা

খাদ্যের তালিকা ও ভোজনের আয়োজন কেবল ভোগের আনন্দই নয়, বরং তা তৎকালীন সমাজের ঐশ্বর্যের প্রতীক। এটি চণ্ডী দেবীর আশীর্বাদে কালকেতুর ভাগ্যোন্নতির প্রতিফলন।

5. সামাজিক সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

খাদ্য তালিকা বর্ণনার মাধ্যমে গ্রামীণ জীবনের সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। এটি বোঝায়, কৃষিভিত্তিক সমাজে খাবার শুধু পেটের প্রয়োজন মেটানোর জন্য নয়, বরং তা সামাজিক বন্ধনের মাধ্যমও ছিল।

ভোজন দেবীর আশীর্বাদ

কালকেতুর ভোজন শুধু একটি সামান্য ভোজ উৎসব নয়, এটি চণ্ডী দেবীর আশীর্বাদের ফল। দেবীর কৃপায় কালকেতু তার গরিব কৃষক জীবনের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠে এবং ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়। ভোজনের আয়োজন এই ঐশ্বর্যেরই প্রতীক, যা দেবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যম।

তৎকালীন সমাজের প্রতিফলন

এই পর্বের মাধ্যমে তৎকালীন সমাজের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, এবং আধ্যাত্মিক চেতনার একটি সমৃদ্ধ ছবি উঠে আসে।

  • অর্থনৈতিক দিক: খাদ্যের বৈচিত্র্য এবং প্রাচুর্য তৎকালীন কৃষি ও নদীনির্ভর সমাজের উর্বরতাকে নির্দেশ করে।
  • সাংস্কৃতিক দিক: উৎসব, ভোজন, এবং অতিথি আপ্যায়নের মধ্য দিয়ে সমাজের সমবেত জীবনের রূপ প্রকাশিত হয়।
  • আধ্যাত্মিক দিক: ভোজনকে দেবীর আশীর্বাদের ফল হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা ধর্মীয় বিশ্বাসের গভীরতাকে তুলে ধরে।

উপসংহার

‘কালকেতুর ভোজন’ পর্বে মুকুন্দ চক্রবর্তী গ্রামীণ জীবনের সজীবতা, খাদ্যসংস্কৃতির বৈচিত্র্য এবং সামাজিক ঐতিহ্যকে কাব্যিক সৌন্দর্যে অমর করে তুলেছেন। কবি খাদ্যের নাম ও বিবরণের মাধ্যমে শুধু একধরনের ভোজ উৎসবের ছবি আঁকেননি, বরং জীবনের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা এবং প্রাচুর্যের উদযাপন প্রকাশ করেছেন। এই অংশ বাংলা মঙ্গলকাব্যের সাহিত্যে স্থায়ী আবেদন রেখে গেছে এবং পাঠকের মনে এক অনন্য আনন্দ ও প্রশান্তি এনে দেয়।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading