মেইজি পুনরুদ্ধারের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি পরীক্ষা করুন। এটা কি সামন্ত বিরোধী আন্দোলন ছিল? মন্তব্য করুন।

মেইজি পুনরুদ্ধারের প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং সামন্ত বিরোধী আন্দোলন:

ভূমিকা: মেইজি পুনরুদ্ধার (Meiji Restoration) ছিল জাপানের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য এবং ঐতিহাসিক পরিবর্তনের মুহূর্ত, যা ১৮৬৮ সালে শুরু হয় এবং প্রায় দুই দশক ধরে দেশটির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে এক নতুন দিশায় পরিচালিত করে। এটি ছিল শোগুনেট ব্যবস্থা (যার অধীনে সামন্তরা শাসন করত) থেকে সংক্ষিপ্ত রাজতন্ত্রের অধীনে একটি আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া। মেইজি পুনরুদ্ধার একটি রাজনৈতিক, সামরিক এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছিল, যার লক্ষ্য ছিল পশ্চিমা শক্তির মোকাবিলা করার জন্য জাপানের আধুনিকীকরণ। তবে, এটি শুধুমাত্র সামন্ত বিরোধী আন্দোলন ছিল না, বরং একটি বৃহত্তর সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, যেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পুনঃস্থাপন এবং আধুনিক সাম্রাজ্য গঠনের প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত ছিল।

মেইজি পুনরুদ্ধারের প্রধান বৈশিষ্ট্য:

১. রাজনৈতিক পরিবর্তন: মেইজি পুনরুদ্ধারের প্রথম এবং অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল জাপানের শোগুনেট শাসনের সমাপ্তি এবং সম্রাটের ক্ষমতা পুনঃস্থাপন। এ সময়, জাপানের সাম্রাজ্যিক শাসন ব্যবস্থার পুরনো কাঠামো ভেঙে একটি নতুন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৬৭ সালে শেষ শোগুন টোকুগাওয়া ইয়োসিনোবু ক্ষমতা সম্রাট মেইজি (মেইজি সম্রাট) এর হাতে হস্তান্তর করেন, যার মাধ্যমে প্রাচীন শোগুনেটের শাসন সমাপ্তি ঘটে এবং জাপানে রাজতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত হয়।

নতুন সরকার “মেইজি সরকার” নামে পরিচিত হয়, যা শোগুনেটের পরিবর্তে রাজতন্ত্রের অধীনে পরিচালিত হতে শুরু করে। সম্রাট মেইজির অধীনে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় এবং মেইজি সরকারের কাজ ছিল আধুনিক ও পশ্চিমি দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করা।

২. সামন্ত শাসনের অবসান: মেইজি পুনরুদ্ধারের সময়ে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল সামন্ত ব্যবস্থা বাতিল করা। শোগুনেটের সময়ে সামন্তরা রাজ্যের বিভিন্ন অংশে ভূমি অধিকারী ছিল এবং তারা ছিল রাজ্যের শাসক। মেইজি সরকার সামন্তশক্তি ধ্বংস করতে এবং আধুনিক প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে চেয়েছিল। ১৮৭১ সালে ‘হান’ ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটে, যেখানে জাপানের প্রাদেশিক শাসকরা তাদের জমি এবং সামরিক বাহিনী হারায়। এই সিদ্ধান্তের ফলে সামন্তশ্রেণী চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জাপানে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপিত হয়।

৩. আধুনিক সামরিক বাহিনীর প্রতিষ্ঠা: মেইজি পুনরুদ্ধারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল আধুনিক সামরিক বাহিনীর প্রতিষ্ঠা। মেইজি সরকার আধুনিক পশ্চিমী মডেল অনুসরণ করে জাপানে একটি শক্তিশালী, সংগঠিত এবং আধুনিক বাহিনী তৈরি করেছিল। এটি মেইজি পুনরুদ্ধারের একটি কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য ছিল—জাপানকে পাশ্চাত্য শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ক্ষমতা প্রদান করা।

১৮৭৩ সালে ‘ন্যাশনাল মিলিটারি কনস্যিপশন’ আইন প্রণয়ন করা হয়, যার মাধ্যমে সমস্ত পুরুষকে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য বাধ্য করা হয়। এর মাধ্যমে, জাপান একটি আধুনিক সেনাবাহিনী গঠন করতে সক্ষম হয়, যা সারা বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

৪. আধুনিক অর্থনীতি শিল্পায়ন: মেইজি পুনরুদ্ধারের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল দেশের অর্থনীতি এবং শিল্পের আধুনিকীকরণ। জাপান পশ্চিমা প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও শিল্প প্রক্রিয়াগুলি গ্রহণ করে এবং দেশটিকে একটি শক্তিশালী শিল্পজাত অর্থনীতি হিসেবে গড়ে তোলে। সরকার বিদেশি প্রযুক্তি ও বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানিয়ে দেশের শিল্প খাতের উন্নতি ঘটায়।

১৮৭০-এর দশকে, সরকার কয়েকটি প্রাথমিক শিল্প উদ্যোগের জন্য সাহায্য প্রদান শুরু করে, যেমন: রেলপথ নির্মাণ, সুতা মিল এবং শিপ বিল্ডিং। মেইজি সরকার মুদ্রানীতি, ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং ব্যবসায়িক আইন সংস্কার করে, যা জাপানের অর্থনীতিকে দ্রুত বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছিল।

৫. শিক্ষা সংস্কৃতি: মেইজি সরকার শিক্ষা খাতে বড় ধরনের সংস্কার নিয়ে আসে। ১৮৭২ সালে জাপানে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পশ্চিমা দেশগুলির শিক্ষা ব্যবস্থা অনুসরণ করে একটি জাতীয় পাঠ্যক্রম গ্রহণ করা হয়। স্কুলগুলিতে বিজ্ঞান, গণিত, এবং পশ্চিমা চিন্তাধারা শেখানো হত, যা দেশের জনগণের চিন্তাভাবনা এবং মনোভাব পরিবর্তন করতে সাহায্য করেছিল।

সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও মেইজি পুনরুদ্ধার প্রভাব ফেলে। পশ্চিমা শিল্প, ফ্যাশন এবং সাহিত্য গ্রহণের ফলে জাপানিরা তাদের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির মধ্যে নতুনত্ব আনে এবং নিজেদের সংস্কৃতি ও পরিচয় সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়।

সামন্ত বিরোধী আন্দোলন হিসেবে মেইজি পুনরুদ্ধার:

মেইজি পুনরুদ্ধার কিছু দিক থেকে একটি সামন্ত বিরোধী আন্দোলন ছিল, কারণ এটি শোগুনেট শাসন ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে একটি আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। শোগুনেট, যা সামন্তদের শক্তি ও প্রভাবের উপর ভিত্তি করে গঠিত ছিল, সেই ব্যবস্থার অবসান ঘটানো মেইজি সরকারের একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল। ১৮৬৮ সালে, মেইজি পুনরুদ্ধারের পর সামন্তদের শাসন ব্যবস্থা বিলুপ্তি হয়, যা একটি জাতীয় প্রশাসনিক কাঠামোর প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ছিল।

তবে, এটি শুধুমাত্র সামন্ত বিরোধী আন্দোলন ছিল না, কারণ মেইজি পুনরুদ্ধার একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন প্রক্রিয়া ছিল, যা দেশকে আধুনিক যুগে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছিল। মেইজি পুনরুদ্ধার সামন্তদের শাসনের অবসান ঘটানোর পাশাপাশি একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের উত্থান, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং সামরিক শক্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি জাপানকে একটি শক্তিশালী আধুনিক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল।

উপসংহার:

মেইজি পুনরুদ্ধার ছিল জাপানের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব, যা শোগুনেটের পতন এবং রাজতন্ত্রের পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে দেশটির আধুনিকীকরণের পথকে উন্মুক্ত করে। এই পুনরুদ্ধারের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক এবং সাংস্কৃতিক স্তরে ব্যাপক সংস্কার। সামন্ত শাসনের অবসান ঘটিয়ে আধুনিক প্রশাসনিক কাঠামো এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করা হয়, যার ফলে জাপান পাশ্চাত্য শক্তির বিরুদ্ধে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। মেইজি পুনরুদ্ধার একটি সামন্ত বিরোধী আন্দোলন ছিল, তবে এটি ছিল একটি বৃহত্তর আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাণের প্রক্রিয়া, যা জাপানকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading