মেহেরগড় সভ্যতার গুরুত্ব:
নব্যপ্রস্তর যুগে কৃষি ও পশুপালনের বিকাশ, মৃৎশিল্পের বিকাশ, বয়নশিল্পের সূচনা, বাসস্থান নির্মাণ প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি লক্ষ করা যায় মেহেড়গড় কেন্দ্রে। 1974 সালে ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ জাঁ ফ্রাঁসোয়া জারিজ এই মেহেরগড় সভ্যতা আবিষ্কার করেন। আনুমানিক 7000 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে তৃতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই বালুচিস্তানের নিকট মেহেরগড়ে এক গ্রাম্য সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এই প্রত্নকেন্দ্রের ব্যাপ্তি প্রায় ১০০ একর এবং মোট সাতটি পর্বে এই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল।
• কৃষি ও পশুপালন:
মেহেরগড়েই ভারতবর্ষের প্রথম কৃষি ও পশুপালন অর্থনীতির উন্মেষ ঘটেছিল। এখানে কাদার তালের উপর যব ও গমের দানার ছাপ পাওয়া গেছে। এ থেকে মনে করা হয় প্রথম যব চাষ এখানেই শুরু হয়েছিল। গৃহপালিত পশু হিসেবে ছাগল, ষাঁড়, ভেড়া পোষ মেনেছিল। বুনো জন্তু মেষও তাদের কাছে পরিচিত ছিল, যা ছিল খাদ্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভাণ্ডার। অতএব শিকারও তখন ছিল একটা তাৎপর্যময় পেশা।
• হাতিয়ার:
মেহেগড়গড় সভ্যতার প্রথম পর্যায়ে নব্যপ্রস্তর যুগের বেশ কিছু হাতিয়ার, যেমন-যাঁতা, হামানদিস্তা, গুঁড়ো করার পাথর, নিড়ানি, কাস্তে, পাথরের ফলক প্রভৃতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এমনকি হাড়ের হাতিয়ারও আবিষ্কৃত হয়েছে। নলখাগড়ার তৈরি ঝুড়ি এবং তার সঙ্গে উল অথবা পশুলোমের তৈরি কাপড় অর্থাৎ বস্তুবয়ন শিল্পের পরিচয় পাওয়া যায়।
• ঘরবাড়ি:
মেহেরগড় সভ্যতার দ্বিতীয় পর্যায়ে (5000-4000 খ্রি.পূ.) কাঁচা ইটের তৈরি বাড়ি পাওয়া গেছে, তবে ইটগুলি নানান আকারের। ইটের তৈরি এই কাঠামোগুলি দেখে শস্যাগার বলে মনে হয়। তবে এই সভ্যতার শেষ অবধি মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শেখে এবং কাঁচা বাড়ির পাশাপাশি পাকা বাড়ি তৈরি করতে শেখে।
• সেচ ব্যবস্থা:
মেহেরগড়ের উন্নত যব, গম চাষের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল জলসেচ ব্যবস্থা। জানা যায় যে, তারা প্রভাবিত স্রোত ধারার স্থানে স্থানে ছোটো ছোটো বাঁধ বানিয়ে জল আটকে রেখেই সেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। জলের ওপর এমন নিয়ন্ত্রণের ফলে সম্ভবত তারা বিপুল পরিমাণে কার্পাস চাষ করতে সক্ষম হয়।
• মৃৎশিল্প:
খ্রিস্টপূর্ব 4000 অব্দের দিকে মেহেরগড় সভ্যতায় কুমোরের দূরন্ত চাকের ব্যবহার শুরু হয়। তার পূর্বে মাটির পাত্র হাতে তৈরি হত। চাকার ব্যবহারের ফলে মৃৎশিল্পের অভাবনীয় উন্নতি ঘটে। কম খরচে ও কম সময়ে বেশি মাটির পাত্র তৈরি হতে লাগল। পাত্রের দাম কমায় সকলের কাছে তা সহজলভ্য হল।
• সমাধি সংস্কৃতি:
মেহেরগড়ের প্রথম পর্যায় থেকেই মৃতকে সমাধিস্থ করার আগে মাটি মাখানো হত। কবরের ভিতরে হত্যা করা পশু, হাতিয়ার এমনকি মূল্যবান অলংকার, যেমন-নীলকান্ত মণিও থাকত। কবরের মূল্যবান সামগ্রীর উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি দেখে তাদের সামাজিক ভেদাভেদের বা বৈষম্যের পরিচয় পাওয়া যায়। এই সভ্যতার দ্বিতীয় পর্যায়ে একটি কারুশিল্পীর সমাধি পাওয়া গেছে, যেখানে পাওয়া গেছে একটি পালিশ করা কুঠার, তিনটি চকমকি পাথর ও 16টি ফলক। এই কবর থেকে প্রাপ্ত বস্তু থেকে তৎকালীন যুগের মানুষের আর্থসামাজিক এমনকি সাংস্কৃতিক অবস্থারও পরিচয় পাওয়া যায়।
• সীলমোহর:
মেহেরগড় সভ্যতার তৃতীয় পর্যায়ে (4000-3200 খ্রি.পূ.) তামার সীলমোহর আবিষ্কৃত হয়েছে। বস্তুত, নিজেদের বাণিজ্যপণ্যকে তারা চিহ্নিত করেছিল তামার সীলমোহর দিয়ে। অর্থাৎ, এই যুগে মেহেরগড়বাসী বহির্বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
মেহেরগড় সভ্যতার আবিষ্কার নানা কারণে ভারতের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ- ① এই সভ্যতার আবিষ্কার প্রমাণ করেছে যে, সিন্ধু পূর্ব যুগে ভারতে এক উন্নত সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। এটি সিন্ধু সভ্যতার প্রাক্-গ্রামীণ সভ্যতা হওয়ায় এটাই প্রমাণ হয়েছে যে, সুমহান হরপ্পা সভ্যতা বিদেশিদের নয় ভারতীয়দেরই সৃষ্টি। এইসব কারণে মেহেরগড় সভ্যতা ভারতের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ।