মৌর্য প্রশাসনিক ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি কি ছিল | What were the salient features of Mauryan Administration? 

মৌর্য প্রশাসনিক ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য

মৌর্য সাম্রাজ্য ছিল প্রাচীন ভারতের অন্যতম বৃহৎ ও শক্তিশালী সাম্রাজ্য, যা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং পরে তার পুত্র বিন্দুসার ও পৌত্র অশোক মৌর্যের শাসনামলে বিস্তৃত হয়েছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত ও কার্যকরী। এই প্রশাসনিক ব্যবস্থার কিছু মূল বৈশিষ্ট্য নিচে আলোচনা করা হলো:

১. কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা

মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কাঠামোর কেন্দ্র ছিল রাজা, যিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। রাজা ছিলেন সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ শাসক এবং সর্বময় কর্তৃপক্ষ। রাজা তার প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনার জন্য একটি মন্ত্রিপরিষদ বা উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছিলেন, যার প্রধান ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, যাকে ‘মহামাত্র’ বলা হতো।

২. মন্ত্রিপরিষদ

মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রশাসনে মন্ত্রিপরিষদ বা উপদেষ্টা পরিষদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এই পরিষদে বিভিন্ন মন্ত্রীরা থাকতেন, যারা বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। প্রধান মন্ত্রীরা ছিলেন:

  • মহামাত্র: প্রধানমন্ত্রী ও রাজদরবারের প্রধান।
  • সেনাপতি: সামরিক বাহিনীর প্রধান।
  • সত্যাধ্যক্ষ: রাজস্ব বিভাগের প্রধান।
  • ধর্মাধ্যক্ষ: ধর্ম ও নৈতিকতার দায়িত্বে।
  • দূতাধ্যক্ষ: বৈদেশিক সম্পর্কের প্রধান।

৩. রাজস্ব সংগ্রহ

মৌর্য সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল কৃষি ও বাণিজ্য। রাজস্ব সংগ্রহ ছিল একটি সুসংগঠিত প্রক্রিয়া। প্রধান রাজস্ব ছিল ভূমি কর, যা কৃষকদের থেকে সংগৃহীত হতো। এছাড়াও শুল্ক, বাণিজ্য কর, খনি কর ইত্যাদি বিভিন্ন উৎস থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করা হতো। রাজস্ব বিভাগের প্রধান ছিলেন সত্যাধ্যক্ষ, যিনি রাজস্ব সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন।

৪. প্রাদেশিক প্রশাসন

মৌর্য সাম্রাজ্যকে বিভিন্ন প্রদেশ বা অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছিল, যেগুলোকে বলা হতো ‘জনপদ’। প্রতিটি জনপদের শাসক ছিলেন ‘কুমার’ বা ‘অর্যপুত্র’, যারা রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন। তাদের সহায়ক হিসেবে ছিলেন মহামাত্ররা, যারা প্রদেশের বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্যাবলী পরিচালনা করতেন।

৫. নগর প্রশাসন

নগর প্রশাসন ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত। প্রতিটি নগর ছিল প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু। নগরের প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন ‘নাগরক’, যিনি নগরের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতেন। নগর প্রশাসনের অধীনে ছিলেন বিভিন্ন কর্মকর্তা, যারা নগরের বিভিন্ন বিভাগের দেখভাল করতেন, যেমনঃ

  • সেনাপতি: নগর নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা।
  • ধনবাধ্যক্ষ: অর্থ ও রাজস্ব সংগ্রহ।
  • পান্যাধ্যক্ষ: বাণিজ্য ও ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ।
  • স্নানাধ্যক্ষ: পানি ও স্নানের ব্যবস্থা।

৬. বিচার ব্যবস্থা

মৌর্য সাম্রাজ্যে বিচার ব্যবস্থা ছিল সুসংগঠিত ও সুবিন্যস্ত। রাজা ছিল সর্বোচ্চ বিচারক। এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ে বিচারকের দায়িত্ব পালন করতেন মহামাত্র ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। গ্রামের স্তরে ‘গ্রামিকা’ বা গ্রামের প্রধান বিচারকের দায়িত্ব পালন করতেন। অপরাধ ও শাস্তির জন্য ছিল সুস্পষ্ট বিধান, যা চাণক্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে বর্ণিত আছে।

৭. গোপনচর ব্যবস্থা

মৌর্য সাম্রাজ্যে গোপনচর বা গুপ্তচর ব্যবস্থার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুর তথ্য সংগ্রহ ও নজরদারির জন্য ছিল একটি শক্তিশালী গুপ্তচর নেটওয়ার্ক। চাণক্য এই গুপ্তচর ব্যবস্থার মূল পরিকল্পক ছিলেন। গুপ্তচররা রাজাকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করতেন, যা প্রশাসনিক ও সামরিক কৌশল নির্ধারণে সহায়ক হতো।

৮. সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা

মৌর্য সাম্রাজ্যের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত উন্নত। সাম্রাজ্য জুড়ে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছিল, যা রাজধানী পাটলিপুত্রকে বিভিন্ন প্রদেশের সাথে সংযুক্ত করেছিল। এই সড়কগুলির পাশে সরাইখানা ও বিশ্রামাগারের ব্যবস্থা ছিল, যা যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের জন্য সুবিধাজনক ছিল।

৯. ধর্ম ও নৈতিকতা

মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ধর্ম ও নৈতিকতার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। অশোক মৌর্যের শাসনামলে সাম্রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটে এবং রাজা নিজে ধর্মপ্রচার ও নৈতিকতার প্রচার করতেন। অশোকের ধর্মলিপিগুলি বিভিন্ন স্থানে খোদিত ছিল, যা জনগণের নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষায় সহায়ক ছিল।

১০. সামরিক ব্যবস্থা

মৌর্য সাম্রাজ্যের সামরিক বাহিনী ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত ও শক্তিশালী। সামরিক বাহিনীর প্রধান ছিলেন সেনাপতি, যিনি রাজাকে সামরিক বিষয়ে সহায়তা করতেন। সেনাবাহিনীতে পদাতিক, অশ্বারোহী, রথ ও হাতির বাহিনী ছিল। সামরিক বাহিনী ছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের শক্তিমত্তার প্রধান ভিত্তি।

উপসংহার

মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সুবিন্যস্ত, সুসংগঠিত এবং কার্যকরী। এই ব্যবস্থা সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ও সমৃদ্ধির মূল ভিত্তি ছিল। চাণক্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ এই প্রশাসনিক ব্যবস্থার মূল তত্ত্ব ও কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের অভিযানের পর মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্থান ও বিস্তার প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। এই সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কাঠামো পরবর্তী যুগে ভারতবর্ষের বিভিন্ন সাম্রাজ্য ও শাসকের জন্য একটি মডেল হিসেবে কাজ করেছে।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading