মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন-
মৌর্য সাম্রাজ্য ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বৃহত্তম এবং শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলির একটি। মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, এবং তার পরবর্তী শাসক অশোকের শাসনকাল ছিল এক উজ্জ্বল যুগ। তবে অশোকের শাসনকালের পরে মৌর্য সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পতন ঘটে। যদিও অশোকের শাসনকাল ছিল এক সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী সময়, তারপরও তাঁর শাসনপদ্ধতির কিছু বৈশিষ্ট্য এবং তার পরবর্তী শাসকরা কীভাবে পরিচালনা করেছেন, তা মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
এ নিবন্ধে আমরা অশোকের শাসনকাল এবং তার ভূমিকার উপর আলোকপাত করব, যাতে তার শাসনের পরবর্তী পরিণতি এবং মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের মধ্যে কী সম্পর্ক ছিল তা বুঝতে পারা যায়।
১. অশোকের শাসনকাল:
অশোক (৩৬৯-২৩৪ খ্রিস্টপূর্ব) ছিলেন মৌর্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট। তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং বি’শণুরথের পুত্র, এবং তার শাসনকাল (২৬৭–২৩৪ খ্রিস্টপূর্ব) ছিল সাম্রাজ্যের জন্য এক ঐতিহাসিক স্বর্ণযুগ। অশোক ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তিনি সমগ্র ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটান এবং তার শাসনকালকে সাম্রাজ্যকে সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে উন্নীত করেন।
অশোকের শাসনকালের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে ছিল তার রাজত্বের সময় বৌদ্ধধর্মের প্রচলন, সমাজে নৈতিকতার ও শান্তির মন্ত্র প্রচার, এবং সাম্রাজ্য জুড়ে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। তিনি তার শাসনকালে অধিকারিত জনগণের কল্যাণের জন্য বহু সংস্কারের উদ্যোগ নেন, যেমন রাস্তা নির্মাণ, সেতু নির্মাণ, জলাশয় খনন এবং বাণিজ্যিক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন।
তবে, অশোকের শাসনকালেও কিছু সমালোচনা রয়েছে, বিশেষত তার রাজনীতির অভ্যন্তরীণ দিক এবং সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কাঠামোর ক্ষেত্রে। কিছু ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে, অশোকের শাসন ব্যবস্থায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ দুর্বলতা ছিল, যা মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী।
২. অশোকের রাজনীতি এবং সাম্রাজ্য পরিচালনা
অশোকের রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য ছিল সাম্রাজ্যের জনগণের কল্যাণ। তিনি নিজেকে একটি ‘ধর্মরাজা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, যার মধ্যে তিনি ধর্মীয় নীতি অনুসরণ করতে পছন্দ করতেন এবং তার শাসনব্যবস্থায় শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালাতেন। তিনি যে ধর্মীয় নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তা ছিল বৌদ্ধ ধর্মের মূল নীতির সাথে মিল রেখে মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং নৈতিক চরিত্র গড়ে তোলা।
তবে, তার রাজনীতি ছিল অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ এবং কখনও কখনও অত্যধিক নৈতিকতার দিকে ঝুঁকে পড়া। বিশেষত, অশোক তার বিজয়ের পর, বিশেষত কলিংগ যুদ্ধের পর, যুদ্ধবিরোধী একটি প্রবণতা গ্রহণ করেন। তিনি যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন, যা পরবর্তীতে সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তির প্রতি প্রভাব ফেলেছিল।
অশোকের শান্তিপূর্ণ নীতি ও ধর্মীয় প্রচার মৌর্য সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তি এবং প্রশাসনিক কাঠামোর উন্নতির জন্য উপকারী ছিল না। তার শান্তিপূর্ণ নীতি এবং বৌদ্ধধর্মের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি সমগ্র সাম্রাজ্যকে এক ধরনের অচল অবস্থায় নিয়ে আসে, যেখানে শাসক শ্রেণীর মধ্যে ক্ষমতার সমর্থন এবং সামরিক শক্তির ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
৩. অশোকের শান্তিপূর্ণ নীতি এবং সামরিক শক্তির দুর্বলতা
অশোকের শান্তিপূর্ণ নীতির এক বিশেষ দিক ছিল তার সামরিক শক্তির প্রতি আগ্রহের অভাব। কলিংগ যুদ্ধের পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি আর কোনো যুদ্ধ করবেন না এবং তার সামরিক বাহিনীকে সঙ্কুচিত করবেন। যদিও এটি তার শান্তির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করে, তবে এর ফলে তার সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে।
শুধু তা-ই নয়, অশোকের ‘ধর্মরাজ’ নীতি অনুসরণ করার ফলে মৌর্য সাম্রাজ্যের সামরিক শ্রেণী এবং কূটনীতিক শ্রেণী তাদের অবস্থান হারাতে শুরু করেছিল। রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতার এই শূন্যতার ফলে, শাসক শ্রেণীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে সাম্রাজ্যের পতনের দিকে নিয়ে যায়।
অশোকের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সাম্রাজ্যের উপর নির্ভরশীল সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে, এবং তার শাসনকালে এর পরিবর্তে সমাজের ধর্মীয় উন্নতির দিকে মনোনিবেশ করা হয়েছিল। ফলে, সামরিক শক্তির অভাব মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা এবং বাইরে থেকে আক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বিরাট বিপদ সৃষ্টি করেছিল।
৪. প্রশাসনিক কাঠামো এবং স্থানীয় শাসন
অশোক তার শাসনব্যবস্থায় প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আনার চেষ্টা করেন, কিন্তু তার প্রশাসনিক কাঠামো তার সাম্রাজ্যের বৃহত্তর অংশে কার্যকরী হয়ে উঠেনি। বিশেষত, স্থানীয় শাসকদের কাছে ক্ষমতার এক ধরনের বিকেন্দ্রীকরণ দেখা যায়, যা পরবর্তীতে সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের অভাব সৃষ্টি করে।
অশোকের শাসনব্যবস্থায়, তিনি স্থানীয় শাসকদের স্বাধীনতা বাড়িয়েছিলেন, যাতে তারা নিজেদের অঞ্চলগুলোতে নিজেদের মত করে শাসন পরিচালনা করতে পারে। এর ফলে, স্থানীয় শাসকদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছিল। এটি প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার এবং সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ একতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা তৈরি করেছিল।
৫. অশোকের শাসনকাল পরবর্তী সময়ের অবস্থা
অশোকের মৃত্যুর পর তার রাজ্য দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে। অশোকের বংশধররা তার মতো শক্তিশালী শাসক হতে পারেননি। তার পরবর্তী রাজা, উপসহাস বা দুর্ভিক্ষের মতো সময়ের শাসকরা ছিলেন দুর্বল, এবং তাদের শাসন ক্ষমতা ছিল সীমিত। এই দুর্বল শাসন ব্যবস্থার কারণে, মৌর্য সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং ভাঙন শুরু হয়।
এছাড়া, মৌর্য সাম্রাজ্য ছিল একটি বিশাল অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত, এবং এর মধ্যে বিভিন্ন জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী ছিল। অশোকের শান্তিপূর্ণ নীতির পর, সাম্রাজ্যকে একত্রিত রাখতে সমন্বিত নেতৃত্ব এবং শক্তিশালী শাসনের অভাব দেখা দেয়। এর ফলস্বরূপ, স্থানীয় শক্তিগুলি নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে শুরু করে, এবং সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসন ক্ষমতা আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।
৬. অশোকের উত্তরাধিকার এবং মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন
অশোকের উত্তরাধিকার ছিল মিশ্র। একদিকে, তিনি শান্তির প্রচার এবং মানবিক মূল্যবোধের জন্য ইতিহাসে স্মরণীয়। তবে, তার রাজনীতি এবং সাম্রাজ্য পরিচালনার কিছু দুর্বলতা মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
মৌর্য সাম্রাজ্য যখন অশোকের মৃত্যুর পর দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন বিভিন্ন স্থানীয় রাজ্যগুলির মধ্যে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়। পরবর্তী শাসকরা রাজ্যটির কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়, এবং সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে বিভক্ত হতে থাকে।
উপসংহার
অশোকের শাসনকাল ছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের একটি উজ্জ্বল সময়, কিন্তু তার শান্তিপূর্ণ নীতি, সামরিক শক্তির প্রতি অবজ্ঞা, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং স্থানীয় শাসকদের শক্তিশালীকরণের ফলে তার শাসনকালের পর মৌর্য সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে পতিত হয়। যদিও অশোকের শাসনকালে ভারতীয় সভ্যতার ব্যাপক সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটেছিল, তবে তার শাসনব্যবস্থা মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের মূল কারণ ছিল।