রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সামাজিক চুক্তি মতবাদ
সামাজিক চুক্তি মতবাদ হলো একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক তত্ত্ব, যা ব্যাখ্যা করে কীভাবে রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে এবং কীভাবে একটি সংগঠিত সমাজ ও শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই মতবাদ অনুসারে, রাষ্ট্রের সৃষ্টি কোনো ঐশী ক্ষমতা বা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে হয়নি, বরং এটি মানুষের মধ্যে একটি পারস্পরিক চুক্তির ফল। এই চুক্তির মাধ্যমে মানুষ তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার কিছু অংশ ত্যাগ করে একটি নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা রাষ্ট্রের অধীনে বাস করতে রাজি হয়, যা তাদের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে।
এই মতবাদটি প্রধানত তিনজন বিখ্যাত রাজনৈতিক দার্শনিকের চিন্তায় গড়ে উঠেছে। তারা হলেন:
- থমাস হবস (Thomas Hobbes)
- জন লক (John Locke)
- জ্যাঁ–জাক রুশো (Jean-Jacques Rousseau)
১. থমাস হবসের মতবাদ
রচনা: লেভিয়াথান (Leviathan), 1651
হবসের মতবাদ:
থমাস হবস ছিলেন সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রথম প্রবক্তা। তিনি মানুষের “প্রাকৃতিক অবস্থা” (State of Nature) সম্পর্কে আলোচনা করেন। হবসের মতে, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের জীবন ছিল “বিরক্তিকর, পশুত্বপূর্ণ ও সংক্ষিপ্ত” (Nasty, Brutish, and Short)।
প্রাকৃতিক অবস্থার বৈশিষ্ট্য:
- প্রাকৃতিক অবস্থায় কোনো সরকার বা আইন ছিল না।
- মানুষের মধ্যে স্বার্থপরতা, আত্মরক্ষা এবং শক্তির প্রাধান্য ছিল।
- “মানুষ মানুষের জন্য নেকড়ে” (Man is a wolf to man) – এই অবস্থায় প্রতিটি মানুষ নিজের স্বার্থে অন্যকে আঘাত করতে প্রস্তুত ছিল।
সামাজিক চুক্তি:
হবসের মতে, মানুষ এই অরাজকতা ও সংঘর্ষ থেকে মুক্তি পেতে একটি সামাজিক চুক্তি করে। এই চুক্তির মাধ্যমে তারা তাদের স্বাধীনতার একটি বড় অংশ ত্যাগ করে একটি সর্বশক্তিমান কর্তৃপক্ষের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে, যাকে তিনি “সার্বভৌম” (Sovereign) বলেছেন।
সরকারের প্রকৃতি:
- হবসের মতে, এই সার্বভৌম শক্তি সর্বময় এবং চূড়ান্ত হবে।
- সরকার স্বৈরতান্ত্রিক হতে পারে, কারণ কেবল একটি শক্তিশালী সরকারই সমাজে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে পারে।
হবসের রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য:
- রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হলো মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও শান্তি নিশ্চিত করা।
- ব্যক্তির স্বাধীনতা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে।
সমালোচনা:
- হবসের মতবাদে স্বৈরশাসনের প্রতি পক্ষপাত লক্ষ্য করা যায়।
- তিনি ব্যক্তিস্বাধীনতার গুরুত্ব যথাযথভাবে তুলে ধরেননি।
২. জন লকের মতবাদ
রচনা: টু ট্রিটিজ অফ গভর্নমেন্ট (Two Treatises of Government), 1689
লকের মতবাদ:
জন লক প্রাকৃতিক অবস্থাকে হবসের মতো নৈরাজ্যমূলক বলে মনে করেননি। তার মতে, প্রাকৃতিক অবস্থা ছিল শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত। তবে সেখানে কোনো প্রকৃত আইন বা বিচারব্যবস্থা ছিল না, যার কারণে ব্যক্তির অধিকার লঙ্ঘিত হতো।
প্রাকৃতিক অবস্থার বৈশিষ্ট্য:
- প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের মধ্যে কিছু “প্রাকৃতিক অধিকার” ছিল। যেমন:
i) জীবন রক্ষা করার অধিকার
ii) স্বাধীনতার অধিকার
iii) সম্পত্তির অধিকার - কিন্তু এসব অধিকার রক্ষা করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা আইন ছিল না।
সামাজিক চুক্তি:
জন লকের মতে, মানুষ তাদের প্রাকৃতিক অধিকার রক্ষা করার জন্য একটি সামাজিক চুক্তিতে প্রবেশ করে। এই চুক্তির মাধ্যমে তারা একটি সরকার গঠন করে এবং সরকারকে কিছু ক্ষমতা প্রদান করে। তবে এই চুক্তির মাধ্যমে মানুষের মৌলিক অধিকার সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করা হয় না।
সরকারের প্রকৃতি:
- লক সরকারের তিনটি কাজ নির্দেশ করেন:
i) আইন প্রণয়ন (Legislative)
ii) আইন প্রয়োগ (Executive)
iii) বিচারব্যবস্থা চালু করা (Judiciary) - লকের মতে, সরকার গণতান্ত্রিক ও সীমাবদ্ধ হতে হবে।
জনগণের অধিকার:
- যদি সরকার জনগণের অধিকার লঙ্ঘন করে, তবে জনগণের অধিকার আছে সরকারকে পরিবর্তন করার (Right to Revolt)।
লকের রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য:
- সরকারের লক্ষ্য হলো জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা।
- জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।
সমালোচনা:
- লকের মতবাদে রাষ্ট্রের ক্ষমতা সীমিত করা হয়েছে, যা কোনো জটিল পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
৩. জ্যাঁ–জাক রুশোর মতবাদ
রচনা: দ্য সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট (The Social Contract), 1762
রুশোর মতবাদ:
রুশো প্রাকৃতিক অবস্থাকে “স্বর্ণযুগ” হিসেবে চিত্রিত করেন। তার মতে, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষ ছিল সহজ-সরল এবং সুখী। কিন্তু বেসরকারি সম্পত্তির ধারণা আসার পর মানুষের মধ্যে স্বার্থপরতা ও বৈষম্য দেখা দেয় এবং সমাজে সংঘাত শুরু হয়।
প্রাকৃতিক অবস্থার বৈশিষ্ট্য:
- প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষ “স্বাধীন” ছিল এবং পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল।
- বেসরকারি সম্পত্তির সৃষ্টি সমাজে অন্যায় ও অসাম্য তৈরি করেছে।
সামাজিক চুক্তি:
রুশোর মতে, সমাজে সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ একটি সাধারণ ইচ্ছা (General Will)-এর ভিত্তিতে চুক্তিতে প্রবেশ করে। এই চুক্তির মাধ্যমে একটি সামগ্রিক সমাজ ও সরকার গঠিত হয়।
সরকারের প্রকৃতি:
- রুশোর মতে, সরকার জনগণের সাধারণ ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে বাধ্য।
- সার্বভৌম ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে এবং তারা প্রত্যক্ষভাবে শাসনে অংশগ্রহণ করে।
ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সাম্য:
- রুশোর মতে, প্রকৃত স্বাধীনতা হলো “সাধারণ ইচ্ছার” অধীন জীবনযাপন করা।
- তিনি সাম্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
সমালোচনা:
- রুশোর “সাধারণ ইচ্ছা” ধারণাটি অস্পষ্ট।
- তার তত্ত্বে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
উপসংহার
সামাজিক চুক্তি মতবাদ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি যুক্তিসঙ্গত ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা প্রদান করে। থমাস হবস, জন লক ও জ্যাঁ-জাক রুশো তিনজনই এই তত্ত্বের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন।
- হবস রাষ্ট্রকে শক্তিশালী কর্তৃপক্ষ হিসেবে দেখিয়েছেন, যা সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে।
- লক ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের সুরক্ষাকে রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য বলেছেন।
- রুশো সাম্য ও সাধারণ ইচ্ছার ভিত্তিতে একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেছেন।
এই তিন দার্শনিকের চিন্তাধারার সমন্বয়ে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা বিকশিত হয়েছে, যেখানে জনগণের অধিকার, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।