রাষ্ট্রের কার্যাবলী সম্পর্কে জনকল্যাণমূলক তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা করো।  Discuss in brief the ‘Welfare Theory about the functions of the State’.

জনকল্যাণমূলক তত্ত্ব (Welfare State Theory) এবং রাষ্ট্রের কার্যাবলী

জনকল্যাণমূলক তত্ত্ব রাষ্ট্রের এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি যা রাষ্ট্রকে শুধু শাসক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, বরং নাগরিকদের কল্যাণ ও সমাজের উন্নতি সাধনে প্রধান ভূমিকা পালনকারী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে চায়। এই তত্ত্বের ভিত্তি হলো রাষ্ট্রের প্রধান কার্যাবলী হলো নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হলো এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যেখানে সবাই সমান সুযোগ পায় এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।

জনকল্যাণমূলক তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ:

  1. নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা:
    জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হলো নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান, এবং খাদ্য নিশ্চিত করা। রাষ্ট্র এই অধিকারগুলো বাস্তবায়ন এবং সুরক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
  2. সামাজিক নিরাপত্তা:
    রাষ্ট্র জনগণের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করে, যেমন পেনশন, বেকার ভাতা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, অসুস্থতার সময় ভাতা ইত্যাদি। এটি জনগণের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং সামাজিক অনিশ্চয়তা কমাতে সাহায্য করে।
  3. শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সেবা:
    জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সবার জন্য উন্মুক্ত ও সুলভ। এটি জনগণের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক উন্নতির জন্য কাজ করে। রাষ্ট্র এ বিষয়ে যথাযথ নীতি প্রণয়ন করে এবং কার্যকরী প্রতিষ্ঠান গঠন করে।
  4. আর্থিক সহায়তা এবং সমতা:
    রাষ্ট্র আর্থিক দিক থেকে মানুষের মধ্যে সমতা আনার জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করে, যেমন দরিদ্র জনগণের জন্য ভর্তুকি, খাদ্য সহায়তা, বাসস্থান প্রকল্প ইত্যাদি। এর উদ্দেশ্য হলো সমাজে চরম দারিদ্র্য এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানো।
  5. নৈতিক নীতি এবং সমতা:
    জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র সাধারণত নৈতিকতার প্রতি এক বিশেষ গুরুত্ব দেয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো নাগরিকদের মাঝে ন্যায়, সমতা এবং সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিককে সমান অধিকার ও সুযোগ প্রদান করার চেষ্টা করে।

রাষ্ট্রের কার্যাবলী এবং জনকল্যাণমূলক তত্ত্বের বাস্তবায়ন:

  1. স্বাস্থ্যসেবা:
    জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের একটি প্রধান কার্যাবলী হলো নাগরিকদের জন্য সহজলভ্য এবং মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা। এ জন্য রাষ্ট্র হাসপাতাল, ক্লিনিক, চিকিৎসা সহায়তা, এবং রোগ প্রতিরোধ কার্যক্রম চালায়।
  2. শিক্ষা:
    রাষ্ট্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো জনগণের জন্য মৌলিক শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা এবং শিক্ষার মান উন্নত করা। রাষ্ট্র শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার করে, শিক্ষার সুযোগ সবার জন্য সমান করে এবং এটি জনগণের সাফল্যের ভিত্তি তৈরি করে।
  3. কর্মসংস্থান:
    জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র কর্মসংস্থান তৈরি করার জন্য নীতি প্রণয়ন করে এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালায়। এটি শ্রমিকদের জন্য সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ এবং তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করে।
  4. আর্থিক সহায়তা:
    দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য রাষ্ট্র বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে, যাতে তারা মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে। এই সহায়তা পদ্ধতি সাধারণত সরকারী ভাতা, সাবসিডি এবং সহায়ক প্রকল্পের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়।
  5. সামাজিক নিরাপত্তা:
    জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র অবসরকালীন জীবন, অসুস্থতা, দুর্ঘটনা, এবং বেকারত্বের সময় নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালায়। এটি সামাজিক নিরাপত্তার নেটওয়ার্ক হিসেবে কাজ করে এবং জনগণের অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবেলা করতে সাহায্য করে।

জনকল্যাণমূলক তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা:

  1. অর্থনৈতিক চাপ:
    জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের কার্যক্রম বাস্তবায়নে বিশাল আর্থিক খরচ হয়, যা কখনো কখনো রাষ্ট্রের জন্য আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে। বেশি সামাজিক সহায়তা প্রদান করলে রাষ্ট্রের বাজেট ঘাটতি হতে পারে।
  2. বাজারের অবস্থা:
    রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক ব্যবস্থা কখনো কখনো বাজার অর্থনীতির সঙ্গে ভারসাম্য রাখতে ব্যর্থ হয়। যখন সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দেয়, তখন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের কার্যকারিতা হ্রাস পেতে পারে।
  3. অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা:
    নাগরিকদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কল্যাণমূলক সহায়তা সমাজে নির্ভরশীলতা সৃষ্টি করতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

উপসংহার

জনকল্যাণমূলক তত্ত্ব রাষ্ট্রের কার্যাবলীর একটি আদর্শ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে, যেখানে রাষ্ট্র নাগরিকদের কল্যাণের জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এটি সুশাসন, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করে, যাতে সমাজে ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে, এর বাস্তবায়নেও কিছু সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, বিশেষত আর্থিক খরচ এবং বাজারের অবস্থা নিয়ে সমস্যা হতে পারে। তবুও, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব যা রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য এবং কার্যক্রমের মধ্যে মানব কল্যাণের গুরুত্বকে তুলে ধরে।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading