রাষ্ট্রের প্রকৃতি এবং কার্যাবলী সম্পর্কে উদারনীতিবাদ তত্ত্বটি আলোচনা কর।  Discuss the liberal theory on the nature and functions of the State.

রাষ্ট্রের প্রকৃতি এবং কার্যাবলী সম্পর্কে উদারনীতিবাদ

উদারনীতিবাদ (Liberalism) হলো একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক তত্ত্ব, যা ব্যক্তিস্বাধীনতা, আইনের শাসন, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের ওপর গুরুত্ব দেয়। এই তত্ত্বের মূল লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ রেখে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও অধিকারকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রক্ষা করা।

মূল দিক:

  • ব্যক্তির স্বাধীনতাই সর্বোচ্চ মূল্যবোধ।
  • রাষ্ট্রের ভূমিকা সীমিত থাকবে এবং এটি ন্যূনতম হস্তক্ষেপ করবে।
  • আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষায় রাষ্ট্রের কার্যাবলী প্রয়োজন।

উদারনীতিবাদের তাত্ত্বিক পটভূমি

উদারনীতিবাদ তত্ত্বের বিকাশ প্রধানত ইউরোপে ১৭১৮ শতকে ঘটে, বিশেষত আলোচনা যুগে (Age of Enlightenment)। এই সময়ে দার্শনিকরা ব্যক্তিস্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

উদারনীতিবাদের প্রধান চিন্তাবিদরা হলেন:

  1. জন লক (John Locke)
  2. অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith)
  3. জে এস মিল (J.S. Mill)
  4. ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant)

উদারনীতিবাদের রাষ্ট্রের প্রকৃতি

উদারনীতিবাদী তত্ত্বের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও কার্যাবলির মূল বৈশিষ্ট্য হলো:

. সামাজিক চুক্তির ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সৃষ্টি

উদারনীতিবাদী দার্শনিক জন লকের মতে, রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক চুক্তি (Social Contract) থেকে। মানুষ প্রাকৃতিক অবস্থায় স্বাধীন ছিল, কিন্তু তাদের অধিকার রক্ষার জন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন দেখা দেয়।

  • জন লকের মতে: রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হলো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

. সীমিত রাষ্ট্র ক্ষমতা

উদারনীতিবাদ রাষ্ট্রের ক্ষমতা সীমিত রাখার পক্ষপাতী। তাদের মতে, রাষ্ট্রের কাজ শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং ব্যক্তি অধিকার নিশ্চিত করা।

  • রাষ্ট্রের সীমিত ক্ষমতা ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটায়।

. ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষা

উদারনীতিবাদের মতে রাষ্ট্র ব্যক্তির স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করবে, তবে তাতে হস্তক্ষেপ করবে না। এটি ব্যক্তিস্বাধীনতার অগ্রগতি ও বিকাশে সহায়তা করবে।

. আইন শাসনের শাসন (Rule of Law)

রাষ্ট্র পরিচালনা হবে আইনের শাসন অনুসারে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আইনের ঊর্ধ্বে নয়।

. গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা

উদারনীতিবাদ গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন জানায়। তাদের মতে, জনগণের ইচ্ছা ও অংশগ্রহণের ভিত্তিতে সরকার গঠিত হবে এবং জনগণকে জবাবদিহি করতে হবে।

. অর্থনৈতিক স্বাধীনতা

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদ বাজার অর্থনীতি (Market Economy) এবং অল্প হস্তক্ষেপের নীতি (Laissez-Faire Policy) প্রচার করে।

  • অ্যাডাম স্মিথ বলেন, মুক্ত বাজারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব।
  • রাষ্ট্র অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কম হস্তক্ষেপ করবে।

উদারনীতিবাদের রাষ্ট্রের কার্যাবলী

উদারনীতিবাদী তত্ত্বে রাষ্ট্রের কার্যাবলী সীমিত এবং নির্দিষ্ট। এর মূল কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে:

. জীবন, স্বাধীনতা সম্পত্তির রক্ষা

উদারনীতিবাদের মূল লক্ষ্য হলো ব্যক্তি অধিকার রক্ষা করা। রাষ্ট্রের কাজ হলো:

  • নাগরিকদের জীবন রক্ষা করা।
  • স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা।
  • ব্যক্তির সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান করা।

. আইন শৃঙ্খলা রক্ষা

রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সমাজে শান্তি এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখা। এটি নাগরিকদের মধ্যে সংঘাত নিরসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে।

. সীমিত সরকার ব্যবস্থা

উদারনীতিবাদের মতে, রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ন্যূনতম থাকবে। রাষ্ট্র শুধু মৌলিক প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোতে হস্তক্ষেপ করবে।

. অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ

রাষ্ট্র মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে উৎসাহিত করবে এবং ব্যক্তির অর্থনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষা করবে। উদারনীতিবাদী অর্থনীতির মূলনীতি হলো:

  • ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বাধীনতা প্রদান।
  • রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগকে উৎসাহিত করা।

. মৌলিক অধিকার রক্ষা

রাষ্ট্র নাগরিকদের মৌলিক অধিকার যেমন: বাকস্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা এবং শিক্ষা অধিকার রক্ষা করবে।

. আন্তর্জাতিক শান্তি সহযোগিতা

উদারনীতিবাদ আন্তর্জাতিক শান্তির পক্ষে। রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান জানিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা ও বাণিজ্যের মাধ্যমে উন্নয়নের পথ খুঁজবে।

উদারনীতিবাদের সমালোচনা

১. অসাম্যের উৎস:
উদারনীতিবাদ ব্যক্তি ও বাজারের স্বাধীনতাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ায় ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে।

২. দুর্বল রাষ্ট্র ব্যবস্থা:
রাষ্ট্রের ভূমিকা সীমিত রাখার ফলে রাষ্ট্রের কার্যকারিতা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।

৩. ব্যক্তিস্বার্থের অগ্রাধিকার:
ব্যক্তিস্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় সামাজিক স্বার্থ অনেক সময় অবহেলিত হয়।

৪. অর্থনৈতিক শোষণ:
মুক্ত বাজার অর্থনীতি অনেক সময় কর্পোরেটদের ক্ষমতাশালী করে তোলে এবং শোষণের পথ তৈরি করে।

উপসংহার

উদারনীতিবাদ তত্ত্ব ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সীমিত রাষ্ট্রের ধারণাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এটি আধুনিক গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে এর সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করার জন্য সমসাময়িক চিন্তাবিদরা রাষ্ট্রের ভূমিকা পুনর্গঠন করেছেন। উদারনীতিবাদ এখন কল্যাণমূলক রাষ্ট্র (Welfare State) ধারণার মাধ্যমে ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের মধ্যে সমন্বয় স্থাপন করছে। এটি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে টিকে আছে।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading