রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে মার্কসের মতবাদ সংক্ষেপে আলোচনা কর

রাষ্ট্র সম্পর্কিত মার্কসীয় রচনা :

রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি সম্পর্কে মার্কসের মতবাদ একটি বৈজ্ঞানিক মতবাদ। মার্কস তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা কোনো একটি বিশেষ বইয়ে প্রকাশ করেননি। এঙ্গেলসের সাথে একত্রে লেখা ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তেহার’ ছাড়াও  ‘The German Ideology’; ‘The Class Struggle In France’; ‘Critique of Hegel’s doctrine of the State’, ‘Das Capital’ ইত্যাদিতে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসের চিন্তা প্রকাশ করেছে। উপরন্তু, লেনিনের পরবর্তী লেখাগুলোতে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে।

রাষ্ট্রের উৎপত্তি বা প্রকৃ

রাষ্ট্রের উৎপত্তি বা প্রকৃতি :

মার্কসবাদের মতে, রাষ্ট্রের উত্থান দুর্ঘটনাক্রমে ঘটেনি। উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলে রাষ্ট্রের জন্ম হয় সামাজিক বিবর্তনের এক বিশেষ অধ্যায়ের। অনন্তকাল থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নেই। আদিম কমিউনিস্ট সমাজের কোনো রাষ্ট্র ছিল না। সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের পর রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়।

রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি বিশ্লেষণে মার্কস ও এঙ্গেলস সমাজ বিকাশের পাঁচটি স্তরের কথা বলেছেন। এগুলি হলো–

I) আদিম সাম্যবাদী সমাজ।

II)  দাস সমাজ।

III) সামন্ততান্ত্রিক সমাজ।

IV) ধনতান্ত্রিক সমাজ।

V)  সমাজতান্ত্রিক সমাজ।

I)  আদিম সাম্যবাদী সমাজ : –

 মানবসমাজের অগ্রগতির প্রাথমিক স্তর হলো আদিম সাম্যবাদী সমাজ। এই সমাজের মূল ভিত্তি ছিল সাম্য। আদিম সমাজে কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি না থাকার জন্য সমাজে শ্রেণি বা শ্রেণিশোষণের জন্ম হয়নি। সেজন্য শ্রেণিশোষণের যন্ত্র রাষ্ট্রও তখন ছিল না।

II) দাস সমাজ : –

শ্রেণী সমাজের প্রথম স্তর দাস সমাজ। এই সমাজ দাস-মালিক ও ক্রীতদাসের মধ্যে বিভক্ত ছিল। ক্রীতদাসরা তাদের মালিকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে বিবেচিত হত। দাস-মালিকরা ক্রীতদাসদের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখত। সামাজিক অগ্রগতির এই পর্যায়ে রাষ্ট্র প্রথমে দাসদের শোষণের হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়।

III) সামস্ত সমাজ : –

সামন্ত সমাজে রাষ্ট্রের আকারে কিছু পার্থক্য ছিল, কিন্তু উদ্দেশ্যের কোনো পার্থক্য ছিল না। এখানেও সমাজ দুটি স্বতন্ত্র শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। একদিকে সামন্ত প্রভু ও ভূস্বামী, অন্যদিকে জমিদাররা। সামন্ত প্রভুরা শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার জন্য রাষ্ট্রকে জবরদস্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত।

IV)  ধনতান্ত্রিক সমাজ : –

পুঁজিবাদী সমাজ সবচেয়ে উন্নত শোষিত সমাজ হিসেবে পরিচিত। এই সমাজে শ্রেণী শোষণ নতুন রূপ গ্রহণ করে। সমাজ দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল, সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণী এবং বুর্জোয়া মালিক শ্রেণী। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রেণী দ্বন্দ্বের চেহারা অনেক সহজ। এখানে বুর্জোয়ারা যারা উৎপাদনের উপায়ের মালিক তাদের নিজেদের শ্রেণীস্বার্থে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে। রাষ্ট্রীয় কাঠামো বুর্জোয়াদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তৈরি করা হয়েছে।

V) সমাজতান্ত্রিক সমাজ :-

মার্কসের মতে, বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ধ্বংসের ফলে ‘সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্র এখনও বিদ্যমান থাকবে। কিন্তু সেই রাজ্যের প্রকৃতি অনন্য। সংখ্যালঘুদের সুবিধার জন্য রাজ্য এখানে সংখ্যাগুরুর বিরুদ্ধে পরিচালিত হবে না। এই রাষ্ট্র একটি ‘সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র’। এখানে ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে উৎপাদনের ওপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে।

 সমালোচনা : –

 রাষ্ট্র সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্বটি বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে।

A) রাষ্ট্রের উৎপত্তি, প্রকৃতি এবং পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মার্কস শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উৎপাদনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

B)  স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আর একটি নতুন রাষ্ট্র ও সমাজের উদ্ভব ঘটবে বলে মার্কসীয় মতবাদে যা বলা হয়েছে তা নিয়তিবাদের মতো একটি ভ্রান্ত ধারণা বলে সমালোচকরা মনে করেন।

C)  মার্কস রাষ্ট্রকে শ্রেণিশোষণের হাতিয়ার রূপে উল্লেখ করে মালিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষার মাধ্যম হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আধুনিক সমাজকল্যাণকর রাষ্ট্রের কথা তিনি ভাবতে পারেননি।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading