লোকসংস্কৃতির সংজ্ঞা:
লোকসংস্কৃতি এই দেশের মানুষের হূদয়ের কথা বলে, মাটির কথা বলে। সহজ-সাবলীল ভাষায় জীবনের সুন্দরতম দিকটির কথা বলে যায় আমাদের গ্রাম বাংলার লোকজ সংস্কৃতি। কবি গান, পালা গান, জারি গান, মুর্শিদি গান, নৌকাবাইচ, হাডুডু খেলাসহ আরো অনেকরকম ঐতিহ্য আছে এই দেশের, যা বাংলাদেশকে আলাদা করে তুলে অন্য সবার থেকে।
বাংলার লোকসংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা:
মানুষের জীবন-চর্চা ও চর্যার সমন্বিত রূপই সংস্কৃতি। স্যার ই বি টাইলর সংস্কৃতি প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, “জ্ঞান-বিজ্ঞান, আচার-বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতিবোধ, আইন-কানুন এবং অনুশীলন ও অভ্যাস এবং অন্যান্য সব সম্ভাবনা যা মানুষ সমাজের সদস্য হিসেবে আহরণ করে তাই সংস্কৃতি” ‘সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিতত্ত্ব’, বুলবন ওসমান, । এই সংজ্ঞা অনুসরণ করলে সহজেই বোঝা যাবে সংস্কৃতির পরিধি কত ব্যাপক।
বাংলার সংস্কৃতিকে নগর-সংস্কৃতি, লোকসংস্কৃতি ও আদিম সংস্কৃতি— এই তিন শ্রেণিতে বিন্যাস করা চলে ‘বাংলার লোকসংস্কৃতি’, ওয়াকিল আহমদ, । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক জীবনযাপনের সুবিধাভোগী শিক্ষিত নগরবাসীর সংস্কৃতিই নগর-সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি মার্জিত-শোভন ও দ্রুত পরিবর্তনশীল, ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা কিংবা স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণায় এর জন্ম নয়। আদিম সংস্কৃতি বাংলার সুদূর অতীতের কৌম সমাজের স্মৃতিনির্ভর আদিবাসীদের সংস্কৃতি। বাংলার লোকসংস্কৃতির সঙ্গে এই আদিম সংস্কৃতির আছে প্রচ্ছন্ন আত্মীয়তা।
প্রকৃতপক্ষে লোকসংস্কৃতিই বঙ্গসংস্কৃতির প্রধান ধারা, এর মর্মমূলেই আবহমান বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য সভ্যতার প্রকৃত পরিচয় প্রোথিত। যথার্থ পরিকল্পিত আধুনিক নগরায়ণ এখনও এদেশে হয়নি। গ্রামীণ সমাজ ও সভ্যতার স্মৃতি ও ছাপ এখনও এই অপরিণত নগরগুলো বহন করছে। জীবন-জীবিকা, আচার-প্রথা ও প্রকৃতিই সংস্কৃতির নিয়ামক। মূলত কৃষি-জীবন ও নদনদী বাংলার সংস্কৃতিকে নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ করেছে। স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামই ছিল বাংলার প্রাণকেন্দ্র এবং সংস্কৃতির উৎস, লালন ও বিকাশ-ক্ষেত্র। এই গ্রামকেন্দ্রিক সংস্কৃতির মধ্যেই বাংলা ও বাঙালির আত্মপরিচয় প্রচ্ছন্ন আছে। এই প্রসঙ্গে আহমদ শরীফের একটি উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে ।