শিখনের গেস্টাল্ট তত্ব:
Gestalt শব্দটি একটি জার্মান শব্দ যার অর্থ হল গঠন বা কাঠামাে বা সম্পূর্ণ আকার বা অবয়ব। উলফগ্যাং কোহলার (Wolfgang Kohler), কূট কফকা (Kurt Koffka) , ম্যাক্স ওয়াদিমার (Max Wertheimer) হলেন গেস্টাল্ট মতবাদের স্রষ্টা।
গেস্টাল্টবাদী বা সমগ্রতাবাদীদের মতে আমরা যখন কোন কিছুকে প্রত্যক্ষণ করি তখন সেটিকে খণ্ড খণ্ড ভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে প্রত্যক্ষ করি না সমগ্রভাবে প্রত্যক্ষ করি। যেমন – একটি সুন্দর ফুলের মালা, মালাটি বিভিন্ন ফুল দিয়ে গাঁথা হয়েছে আমরা ফুলগুলিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখি না, কোনটি কোন ফুল নাদেখে সামগ্রিকভাবে মালাটিকেই দেখি।
গেস্টাল্টবাদীদের মতে শিখন কোন যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়, সমস্যামূলক পরিস্থিতির সমগ্ররূপকে উপলব্ধি করার পরেই শিখন সম্ভব। তাই এই মতবাদকে সমগ্রতাবাদের তত্বও বলা হয়ে থাকে। প্রাণীরা সবসময় প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শেখেনা। একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রাণী যখন কোন উদ্দীপকের প্রতি প্রতিক্রিয়া করে তখন তার প্রতিক্রিয়াগুলি পরস্পর সম্পর্কবিহীন অন্ধ প্রতিক্রিয়া নয়। প্রাণী সমস্ত পরিস্থিতিটিকে সামগ্রিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে এবং সামগ্রিকভাবেই প্রতিক্রিয়া করে। তাই তারা বলেন প্রাণী শিখন হয় অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে। কোহলার ইতর প্রাণী যেমন –মুরগি, কুকুর, শিল্পাঞ্জির উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে প্রাণী কোন অন্ধ বা যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিখেনা। অন্তদৃষ্টিমূলক শিখনের ক্ষেত্রে কোহলারের শিম্পাঞ্জির পরীক্ষাটি বিশেষ উল্লেখযােগ্য।1913 থেকে 1917 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সুলতান নামক একটি শিম্পাঞ্জিকে নিয়ে পরীক্ষা করেন।
শিক্ষাক্ষেত্রে গেস্টাল্ট তত্বের প্রয়ােগ:
শিক্ষাক্ষেত্রে গেস্টাল্ট তত্বের প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গেস্টাল্টবাদিরা মুখস্ত করার পদ্ধতি গ্রহণ করতে চায়না বা প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শিখনের ক্ষেত্রে সময় ও শ্রমের অপচয় হয়। শিখন হয় অন্তদৃষ্টির মাধ্যমে এই প্রক্রিয়াতে শিক্ষার্থীর কল্পনাশক্তি, বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা, চিন্তা করার ক্ষমতা উন্নত হয়। বর্তমান শিক্ষাক্ষেত্রে গেস্টাল্ট মতবাদ কিভাবে প্রভাবিত করেছে তা আলােচনা করা হল-
1) বিষয়বস্তুর সামগ্রিক উপস্থাপন: শ্রেণিকক্ষে কোন বিষয় পড়ানাের সময় শিক্ষক মহাশয় সমগ্র বিষয়বস্তু সম্বন্ধে একটা পূর্ণ ধারণা অর্জন করার জন্য সমগ্র বিষয়টি শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করবেন। তারপর সামগ্রিক বিষয়টিকে খণ্ড-খণ্ড অংশে ভাগ করে বিশ্লেষণ করবেন। যদি প্রথমেই শিক্ষনীয় বিষয়বস্তুটি ছােট ছােট অংশে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করা হয়, তাহলে তারা সমগ্র বিষয়টি সম্বন্ধে পরিপূর্ণ ধারণা অর্জন করতে পারবেনা। যেমন – একটা সম্পূর্ণ কবিতার মধ্যে যে ভাব থাকে তা না বুঝিয়ে যদি কবিতাটির বিভিন্ন অংশ শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরা হয় তাহলে কবিতাটির সম্পূর্ণভাব শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারবেনা।
2) অন্তর্দৃষ্টিমূলক শিখন: গেস্টাল্টবাদীদের মতে শিখন হয় অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে। যখন শিক্ষার্থী সমগ্র সমস্যাটির অন্তর্গত বিভিন্ন অংশগুলির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে তখন তার মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি সৃষ্টি হয়। সুতরাং শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সময় শিক্ষককে বিষয়বস্তু এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা সমস্যামূলক পরিস্থিতির বিভিন্ন অংশের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।
3) যান্ত্রিক প্রচেষ্টার নিরসন: গেস্টাল্টবাদীরামুখস্ত পদ্ধতি বা যান্ত্রিক পদ্ধতি গ্রহণ করতে চায় না। শিখন কোন অন্ধ বা যান্ত্রিক প্রচেষ্টা নয়। শিক্ষার্থীর সময় ও শ্রমের অপচয় না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাই শ্রেণিকক্ষে বিষয়বস্তুকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা পাঠ্য বিষয়ের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পারে মুখস্ত করার প্রবণতা থেকে বিরত থাকে।
4) পৃথকীকরণ ও সামান্যীকরণ: শিক্ষার্থীদের মধ্যে পৃথকীকরণ ও সামান্যীকরণ এই দুই মানসিক প্রক্রিয়া যাতে সৃষ্টি হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। শিক্ষার্থীরা যাতে শিক্ষণীয় বিষয়ের অন্তর্গত অপ্রোজনীয় বিষয়গুলিকে বাদ দিয়ে প্রয়ােজনীয় ও প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলিকে বেছে নিতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
5) শিখনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে শিক্ষার্থীকে অবহিত করা: শিখনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজনা। শিখনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য যদি শিক্ষার্থীর জানানা থাকে এবং শিখন পরিস্থিতি যদি বদ্ধ থাকে তাহলে শিখনও যান্ত্রিক হয়। গেস্টাল্ট মতবাদ শিখন পরিস্থিতিকে উন্মুক্ত রাখে এবং শিক্ষার্থীকে তার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য সম্বন্ধে পূর্ণভাবে জানতে সহায়তা করে। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযােগ পায়।
6) শিক্ষার্থীর সক্রিয়তা: শিখনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সক্রিয়তা একান্তভাবে প্রয়োজন। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তােলার জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপযুক্ত শিক্ষা সহায়ক উপকরণ ব্যবহার করতে হবে। আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি, সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় উপস্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থী পাঠ্য বিষয়ের প্রতি প্রেষণা সৃষ্টি হবে। যাতে শিক্ষার্থী সক্রিয়ভাবে পাঠে অংশগ্রহণ করে।
7) বিষয়বস্তুর ধারাবাহিক উপস্থাপন: শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি জাগিয়ে তােলার জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শিক্ষা দান কালে পাঠ্যবিষয়ের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা সহজেই বিষয়টি আয়ত্ব করতে পারে।
8) সামঞ্জস্যতা: শিখনীয় বিষয় বস্তুর মধ্যে যেগুলাে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত সেগুলিকে কম সময়ের ব্যবধানে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। ফলে শিক্ষার্থীরা এই দুটি বিষয়ের মধ্যে সমন্বয় স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অন্তর্দৃষ্টি জাগ্রত হবে। কিন্তু যদি একটি বিষয় পড়ানাের পর আরেকটি অনেকদিন বাদে পড়ানাে হয় তবে সহজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি জাগ্রত হবে না।
9) বুদ্ধিগত ও প্রাস্কোভিক প্রস্তুতি: শিখনের সাফল্য নির্ভর করে সমস্যামূলক পরিস্থিতির বিভিন্ন অংশের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের উপর। শিক্ষা গ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিগত ও প্রক্ষোভিক প্রস্তুতি থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। শিখন প্রক্রিয়াটিকে এমন ভাবে পরিচালিত করতে হবে শিক্ষার্থীর বােধশক্তি ও গ্রহন ক্ষমতার মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে।
শিক্ষায় গেস্টাল্ট মতবাদের প্রয়োগ:
বর্তমান শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় গেস্টাল্ট মতবাদের গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে শ্রেণিকক্ষে গেস্টাল্ট তত্ত্বকে বিভিন্নভাবে প্রয়ােগ করা হচ্ছে। যেমন—
(১) সমগ্রতার তত্ত্ব: শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক শিক্ষণীয় বিষয়বস্তু প্রথমে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপন করবেন। তারপর সেই সামগ্রিক বিষয়বস্তুকে খণ্ড খণ্ড অংশে ভাগ করে বিশ্লেষণ করবেন। এই নীতির উপর ভিত্তি করে শিক্ষাক্ষেত্রে সমগ্র থেকে অংশের দিকে অগ্রসর হওয়ার শিক্ষানীতি গৃহীত হয়েছে।
(২) শ্রেণিকক্ষে অন্তদৃষ্টিমূলক শিখন: গেস্টাল্ট তত্ত্ব অনুযায়ী শিখন হয় অন্তদৃষ্টির মাধ্যমে। সুতরাং শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সময় শিক্ষককে বিষয়বস্তু এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা সমস্যামূলক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন অংশের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। অর্থাৎ, শিক্ষার্থীদের অন্তদৃষ্টি জাগিয়ে তুলতে হবে।
(৩) শিক্ষার্থীর সক্রিয়তা: অন্তর্দৃষ্টিমূলক শিখন কৌশলে সক্রিয়তার মাধ্যমে বিষয়বস্তু প্রাণী প্রত্যক্ষণ করে। বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সক্রিয়তার নীতিকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সুতরাং, শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় করে তােলার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করবেন। তবেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্তদৃষ্টি জাগানাে সম্ভব হবে।
(৪) সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাদান: গেস্টাল্টবাদীদের মতে, শিক্ষক শিক্ষিকারা যে বিষয়ে শিক্ষা দেন সেই বিষয়গুলির মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে বিষয়টিকে উপস্থাপন করেন।
(৫) শিখনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীর কাছে ব্যক্ত করতে হবে: পাঠগ্রহণের পূর্বে শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ শিক্ষার্থীদের কাছে শিখনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা করবেন।
(৬) মূর্ত থেকে বিমূর্তের দিকে: গেস্টাল্ট শিখন তত্ত্বটি মূর্ত থেকে বিমূর্তের দিকে —এই নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। সুতরাং, শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদানের সময় প্রথমদিকে বাস্তব অর্থাৎ মূর্ত বিষয়ে শিক্ষাদান করবেন এবং পরে ধীরে ধীরে বিমূর্ত বিষয়ের দিকে অগ্রসর হবেন।
(৭) শিখনের অংশগুলির সম্পর্ক স্থাপন: সমস্যাসমাধানের জন্য পরিস্থিতির বিভিন্ন অংশগুলির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা হয়। অন্তষ্টিমূলক শিখন কৌশলে এ কথা মনে রেখে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের মধ্যে এমনভাবে সমস্যার উপস্থাপন করবেন, যাতে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন অংশের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।
(৮) যান্ত্রিক প্রচেষ্টা নিরসন: এই শিখন কৌশলের মতানুযায়ী, শিক্ষকের কর্তব্য হবে শিক্ষার্থীকে মুখস্থ করার প্রবণতা থেকে বিরত করে পাঠ্যবিষয়ের অন্তর্নিহিত অর্থ উপলদ্ধিতে সাহায্য করা।
(৯) পৃথকীকরণ ও সামান্যীকরণ: গেস্টাল্ট তত্ত্বে প্রথমে পৃথকীকরণ, পরে সামান্যধর্মী সূত্র গঠনের মাধ্যমে অন্তদৃষ্টি জাগে। সমস্যামূলক পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা যাতে সামান্যধর্মী সূত্র গঠন করতে পারে, সে সম্পর্কে শিক্ষক সচেতন থাকবেন এবং প্রয়ােজনে কিছুটা ইঙ্গিত দিয়ে ছাত্রদের উৎসাহিত করবেন।
(১০) বিষয়বস্তুকে শিক্ষার্থীর কাছে ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে: শিক্ষার্থীর মধ্যে যাতে সহজে অন্তদৃষ্টি জাগরিত হয় তার জন্য শিক্ষণীয় বিষয়বস্তুকে শিক্ষার্থীর কাছে ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে।