শ্রম বিভাজন ও নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি
যে কোনো সমাজে শ্রম সম্পর্ক এবং শ্রম বিভাজন মানুষের মনস্তত্ব গঠনে ও সমাজ পরিচালনায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। শ্রম সম্পর্কই পরবর্তীতে ক্ষমতা সম্পর্ক নির্ণয় করে। শ্রম সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে দৃষ্টিভঙ্গি। দৃষ্টিভঙ্গিই দর্পণ হিসেবে সমাজের চেহারা আমাদের সামনে তুলে ধরে। দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে সমাজের গতি-প্রকৃতি, মানুষের আচরণ ও সংস্কৃতিগত মান। সেজন্যে কোনো সমাজ কাঠামোকে বুঝতে হলে প্রথমেই বিশ্লেষণ করতে হয় ঐ সমাজের শ্রম বিভাজন ও শ্রম সম্পর্কের রূপ বা প্রকৃতি। যে কোনো কাজ সম্পাদন করতে শ্রমের প্রয়োজন হয়। শ্রমকে আমরা সাধারণত তিনভাবে দেখে থাকি। উৎপাদনশীল শ্রম, অনুৎপাদনশীল শ্রম এবং স্বাধীন শ্রম। আরেকটি অবহেলিত শ্রম পুঁজিবাদী সমাজে বিদ্যমান। তাহলো বাড়ির কাজ বা পারিবারিক শ্রম। অসম ক্ষমতা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতেই এই শ্রমটিকে অবহেলা করা হয়। পুঁজিবাদী সমাজে একজন নারী পরিবার পরিচালনার জন্য ক্লান্তিহীন শ্রম দেয়ার পরেও তার পরিচয় উনি কিছু করেন না। শ্রমের সাথে জড়িয়ে থাকে নগদ অর্থনৈতিক লাভ-লোকসান। যেহেতু পারিবারিক শ্রম নগদ অর্থে পরিমাপ করা হয় না, তাই পুঁজিবাদী সমাজে এই শ্রম মূল্যহীন, অবহেলিত। বর্তমানে আমাদের দেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা রয়েছে। পুঁজিবাদ কিভাবে শ্রম শোষণের মাধ্যমে বৈষম্য টিকিয়ে রাখে তা বুঝতে হলে আমাদের মূলধন, মজুরি ও উদ্বৃত্ত মূল্য বিষয়ে পরিষ্কার জ্ঞান থাকা দরকার। যে কোনো পণ্য তৈরিতে প্রয়োজন হয় মালিকের পুঁজি এবং শ্রমিকের শ্রম। জমির ক্ষেত্রেও মালিক ও বর্গাচাষি নামে আমরা শ্রমিককেই দেখতে পাই। পুঁজি ও শ্রম একটিকে ছাড়া অন্যটি অর্থহীন, বেকার। মালিক বিনিয়োগ করে পুঁজি আর শ্রমিক বিনিয়োগ করে তার মেধা বা শারীরিক শ্রম। তবে পুঁজি ও মজুরি দিয়েই উৎপাদন নিয়মিত করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে আরও দু’টি অনুসঙ্গ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। একটি হচ্ছে উদ্বৃত্ত শ্রম এবং অন্যটি উদ্বৃত্ত মূল্য। ধরা যাক একটি পুতুল ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এখানে পুঁজি ১৫০ টাকা, মজুরি-৫০ টাকা, তাহলে উদ্বৃত্ত মূল্য ৫০টাকা। পুঁজি+মজুরি অর্থাৎ ২০০ টাকা মিলে গঠন করছে পুঁজি। কিন্তুটি পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে- ২৫০ টাকায়। এই যে ৫০ টাকা উদ্বৃত্ত মূল্য এতে শ্রমিকের কোনো অধিকার নেই। যে কোনো শিল্প টিকে থাকার জন্য বিক্রয়মূল্য অবশ্যই উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে বেশি হতে হবে। শ্রমিক পণ্য উৎপাদনের প্রধান চালিকা শক্তি হওয়ার পরেও পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উদ্বৃত্ত মূল্যে ভোগ করে শুধুমাত্র অর্থের যোগানদাতা। অর্থাৎ পুঁজিপতি বা মালিক। উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল শ্রমিক মিলে গঠিত হয়েছে শ্রমিক শ্রেণি। স্বাধীন শ্রম কিছুটা অন্যরকম। এখানে কোনো মালিক নেই। নারী-পুরুষ বা পরিবারের লোকেরা মিলে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা কারখানা চালালে তা স্বাধীন শ্রম হিসেবে পরিগণিত হয়। এখানেও উদ্বৃত্ত মূল্য থাকে। তবে তা ভোগ করা হয় সাধারণত পরিবারগতভাবে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় খুব কম মানুষই স্বাধীন শ্রমের আওতায় থাকে। পূর্বে যে সকল শ্রম সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে পারিবারিক শ্রম তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল শ্রম সম্পর্কের মধ্যে থাকে মালিক-শ্রমিক, কর্মচারী-মনিব সম্পর্ক। আর পরিবার গঠিত হয় আবেগ, আস্থা, বিশ্বাস, পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধের ওপর ভিত্তি করে। ঐতিহাসিকভাবে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই বাড়ির কাজের দায়িত্ব পুরুষানুক্রমে শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে এই বিবেচনায় যে নারী বাইরের কাজের যোগ্য নয়। যদিও এ সময়কালে কিছুসংখ্যক নারী পুরুষের মত বাইরের সব ধরনের কাজে তার যোগ্যতা প্রমাণ করেছে, তা সত্ত্বেও পারিবারিক কাজ থেকে নারীর মুক্তি মেলেনি। ফলে যে সকল নারীরা এখন বাইরে কাজ করছে তাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে দুই ধরনের শ্রম। পুরুষেরা তার মালিকের কাছে শ্রম বিক্রি করে সরাসরি অর্থ নিয়ে আসেন। সেই অর্থ তিনিসহ পরিবারের জীবন নির্বাহের কাজে ব্যয় হয়। পরিবারের যাবতীয় কাজ করেন নারী কিন্তু তা অর্থে রূপান্তরিত হয় না। যেহেতু একটি পরিবারে পুরুষ-নারীর সম্পর্ক মালিক-শ্রমিকের, প্রভু-ভৃত্যের বা কর্মচারী-মনিবের মত নয়। তাই পারিবারিক শ্রমকে অর্থে রূপান্তরের দাবিও অমূলক। ধরা যাক পুরুষ বাইরে থেকে উপার্জন করে পরিবারের বেঁচে থাকার সকল জিনিস এনে দিচ্ছেন। নারী গৃহস্থালির কাজ সম্পাদন করছেন। এখানে পুরুষ নারীর শ্রমকে ব্যবহার করছেন, আবার নারীও পুরুষের শ্রমকে ব্যবহার করছে। অর্থাৎ এদের মধ্যে একটা শ্রম সম্পর্ক রয়েছে। এক্ষেত্রে কোন শ্রম প্রধান এবং কোন শ্রম গৌণ সে বিতর্কে গেলে পরিবার প্রথাকেই উচ্ছেদ করার প্রয়োজন হয়ে পড়বে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষ সরাসরি অর্থ উপার্জনের সাথে জড়িত থাকে তাই পরিবারের কর্তৃত্ব পুরুষের হাতে থাকে। পরিবারে নারী-পুরুষের কাজের ক্ষেত্রে শ্রম-শোষণের কোনো সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও পুরুষের অধীনেই নারীকে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অনেক নারীকে উপার্জনের জন্য গৃহের বাইরে আনতে সক্ষম হলেও পারিবারিক কাজের শ্রম বণ্টনের ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। ফলে যে সকল নারী শুধুমাত্র গৃহস্থালি কাজ সম্পাদন করেন তার ক্ষেত্রেতো বটেই যে নারী বাইরে কাজ করেন তার ক্ষেত্রেও অসম শ্রম বিভাজন কার্যকর থাকে। অর্থাৎ পরিবার এমন একটি জায়গা যেখানে উৎপাদনশীল, অনুপাদনশীল বা স্বাধীন শ্রমের সম্পর্ক না থাকলেও রয়েছে অসম শ্রম বিভাজন। নারী-পুরুষ শ্রম বিভাজন দু’জনের মধ্যকার বৈষম্য টিকিয়ে রাখতে বড় ভূমিকা পালন করে। এই বিভাজনের কারণে পুরুষ নিজেই বাড়ির কর্তা, মালিক বা প্রভু হয়ে যান। সমাজ ও মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে পারিবারিক শ্রমের অবদান– পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যে কোনো শ্রম সরাসরি অর্থের নিরিখে পরিমাপ করা হয়। এ ব্যবস্থা শুধু উৎপাদনশীল বা স্বাধীন শ্রম নয় পারিবারিক শ্রম বা সামাজিক শ্রমকেও অর্থের মানদণ্ডে মাপতে চায়। যা সঠিক নয়। পারিবারিক শ্রম যেহেতু পূর্বে আলোচিত কোন শ্রমের আওতায় পরে না এবং এই শ্রমের সাথে জড়িয়ে আছে নারীর শ্রম ক্ষেত্রে সমানাধিকারের প্রশ্ন, ফলে অর্থের মাপকাঠিতে নয় বরং পারিবারিক শ্রমকে বিচার করতে হবে সামাজিক ও মানবিক মানদণ্ডে। পারিবারিক শ্রমের ব্যবহারিক ও সামাজিক গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারলে এই শ্রম ক্ষেত্রে একটি সাম্যাবস্থা বিরাজ করার পরিস্থিতি তৈরি হবে। সমাজে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের প্রকৃত তাৎপর্য কী? নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষ সমাজে বসবাস করে সামাজিক জীব হিসেবে। বিশ্ব সভ্যতা বিনির্মাণ ও তাকে এগিয়ে নিতে মানুষ প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করছে। প্রতিটি সভ্য মানুষ কোনো না কোনো পরিবারিক পরিমণ্ডলে জন্মায় এবং বেড়ে ওঠে। প্রতিটি পরিবারে কিছু কিছু না কিছু শ্রম সম্পাদিত হয়। কাজেই পারিবারিক শ্রমকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। বরং আমরা যদি এভাবে ভাবি, পারিবারিক শ্রম প্রত্যক্ষ কোনো মূল্য সৃষ্টি করে না, এক অর্থে রূপান্তরিত করা যায় না। তাই পরিবারের নারী-পুরুষকে ঘরের কাজ ও বাইরের কাজের ক্ষেত্রে সমান অধিকার ও দায়-দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় রাষ্ট্র-সমাজ-পরিবার সকল প্রতিষ্ঠানই সযতনে এই শ্রম বিভাজন টিকিয়ে রাখতে চায়। এখন একজন নারী নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে শ্রম বাজারে প্রবেশ করে তখন তাকে ঘরে-বাইরে দুই ধরণের শ্রমই সম্পদন করতে হয়। প্রগতিশীল নারীরা তা করছেনও। যদিও এ সংখ্যা খুবই নগণ্য। অন্যদিকে যে সকল নারীরা শুধুমাত্র গৃহস্থালি কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখছেন তারা নামপরিচয়হীন পরনির্ভরশীল জীবন যাপন করছেন। কর্মজীবী নারীদের ওপর পুরুষের কর্তৃত্ব কিছুটা কম থাকলেও তা একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত থাকে। যে পুরুষ বাইরে মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে নিজেকে নিয়োজিত করে সে পুরুষ ঘরে নারীর সম-মর্যাদায় বিশ্বাসী হতে চায় না। যখন আমরা শ্রম বিভাজন ব্যবস্থার পরিবর্তনের কথা বলব তখন সে পরিবর্তন নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য হতে হবে। ঘরের কাজ আর বাইরের কাজের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক অনুধাবন করতে হবে। পুরোনো শ্রম বিভাজনের জায়গায় নতুন শ্রমবিভাজন প্রবর্তন করেই এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। সময় এগিয়ে যাচ্ছে। সময়কে পেছনে টেনে রাখার চেষ্টা হবে অবান্তর। ‘পুরোনো শ্রম বিভাজন ’ বলতে বোঝায় একজন কেবলমাত্র এক ধরনের শ্রমই সম্পাদন করবে , সেটা শারিরীর বা মানসিক যে কোনো ধরনের শ্রমই হতে পারে। অন্যদিকে নতুন শ্রম বিভাজন বলতে বোঝায় যে কোনো ব্যক্তি সে নারী বা পুরুষ যাই হোক না কেন প্রয়োজন অনুযায়ী সে যে কোনো ধরনের শ্রম সম্পাদন করবে বা করতে প্রস্তুত থাকবে। বর্তমান শোষণভিত্তিক শ্রম বিভাজন ব্যবস্থা যত তাড়াতাড়ি বিলুপ্ত হবে পারিবারিক শ্রম সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তত শিগগিরই পরিবর্তন সূচিত হবে। নতুন শ্রম সম্পর্ক বিভেদ বা বৈষম্য নয় বরং সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা-মমতা আর পরস্পরের প্রতি সম্মানের সম্পর্ক তৈরি করবে। শ্রম সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তন সূচিত করে নারী-পুরুষকে সমমর্যাদায় সমাজে প্রতিস্থাপন করার কাজটি সহজসাধ্য নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে পিতৃতান্ত্রিকতা আর ক্ষমতার রাজনীতি। মালিক-শ্রমিকের রাজনীতি । উদ্বৃত্ত মূল্য একা ভোগ করার রাজনীতি। সর্বোপরি নারীকে সমাজিকভাবে খাটো করে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে অন্যান্য পরিবর্তনের পাশাপাশি নারী-পুরুষ উভয়কে পাল্টনোর দীক্ষা নিতে হবে। পুরুষ নির্ভরশীলতা কমিয়ে নারীকে হতে হবে আত্মবিশ্বাসী ও মর্যাদাবান। প্রতি মুহূর্তে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। নারীকে নিজের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিজেকেই অর্জন করতে হবে, যদি শিশুকাল থেকে আমাদের ছেলেশিশু ও মেয়েশিশু শিক্ষা ও কর্মক্ষমতা অর্জনের ক্ষেত্রে সমান সুযোগ পায় তাহলেই এটা অর্জন করা সম্ভব হবে।