সাক্ষাৎকার (Interview) একটি জনপ্রিয় গবেষণা পদ্ধতি, যা বিশেষভাবে সামাজিক গবেষণা, মনোবিজ্ঞানে, চাকরির নিয়োগ এবং অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। সাক্ষাৎকার হলো একটি আলোচনামূলক প্রক্রিয়া, যেখানে একজন বা একাধিক ব্যক্তি (সাক্ষাৎকারপ্রার্থী) অন্য একজন ব্যক্তির (সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী) সঙ্গে মুখোমুখি প্রশ্ন-উত্তর করেন। এটি একটি ব্যক্তিগত, সশরীর বা ভার্চুয়াল যোগাযোগের মাধ্যম হতে পারে, যেখানে মূলত প্রশ্নের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের কাজ হয়।
সাক্ষাৎকারের মূল উদ্দেশ্য হলো নির্দিষ্ট তথ্য বা দৃষ্টিভঙ্গি সংগ্ৰহ করা। গবেষণার ক্ষেত্রে, এটি একটি গবেষণার টুল হিসেবে ব্যবহৃত হয় যা গবেষকের জন্য লক্ষ্যিত জনগণের অভিজ্ঞতা, মতামত, বা আস্থার বিষয়ে গভীরতর অন্তর্দৃষ্টি প্রাপ্তির একটি পথ। সাক্ষাৎকারগুলির ধরন, কাঠামো এবং প্রশ্নের ধরন নানা ধরনের হতে পারে, যার ফলে এটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে খুবই উপকারী হয়ে ওঠে।
সাক্ষাৎকারের সংজ্ঞা:
সাক্ষাৎকার বলতে বোঝায় একটি মৌখিক সংলাপ, যেখানে এক ব্যক্তি (সাক্ষাৎকারপ্রার্থী) আরেকজন ব্যক্তির (সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী) থেকে তথ্য বা মতামত সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেন। সাক্ষাৎকার সাধারণত প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে সংঘটিত হয়, এবং এটি একটি প্রক্রিয়া যেখানে একাধিক বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনা করা হয়। সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এমন তথ্য সংগ্রহ করা হয় যা সাধারণত অন্য কোনো মাধ্যম বা পদ্ধতিতে পাওয়া সম্ভব নয়।
সাক্ষাৎকারের ধরন:
সাক্ষাৎকারের বিভিন্ন ধরনের ধারণা বা মডেল রয়েছে, যা গবেষণার উদ্দেশ্য, প্রশ্নের ধরণ এবং সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীর পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে বিভিন্নভাবে বিভক্ত হতে পারে। সাক্ষাৎকারগুলির মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকে, যার মধ্যে প্রাথমিকভাবে জনপ্রিয় কিছু ধরন হল:
১. স্ট্রাকচারড (Structured) সাক্ষাৎকার:
স্ট্রাকচারড বা কাঠামোবদ্ধ সাক্ষাৎকারে প্রশ্নগুলি পূর্বনির্ধারিত এবং নির্দিষ্ট থাকে। এগুলি সাধারণত তালিকা বা কাগজে লেখা থাকে, এবং সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী সাক্ষাৎকারপ্রার্থীকে সেই প্রশ্নগুলির সঠিক উত্তর দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেন। এই ধরনের সাক্ষাৎকারে খুব কম স্পেস থাকে যুক্তি বা অনুসন্ধানের জন্য, কারণ এটি একটি নির্দিষ্ট কাঠামো অনুযায়ী চলে। স্ট্রাকচারড সাক্ষাৎকারগুলি সাধারণত সঠিক, সহজ এবং পুনরাবৃত্তিযোগ্য ফলাফল দেয়।
উদাহরণ: চাকরির সাক্ষাৎকার, যেখানে আবেদনকারীর যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতা নির্দিষ্ট প্রশ্নের মাধ্যমে যাচাই করা হয়।
২. সেমি–স্ট্রাকচারড (Semi-structured) সাক্ষাৎকার:
সেমি-স্ট্রাকচারড সাক্ষাৎকারে প্রশ্নগুলি পূর্বনির্ধারিত থাকে, তবে এখানে কিছু অতিরিক্ত স্থান থাকে উন্মুক্ত প্রশ্ন বা অনুসন্ধানমূলক আলোচনা করার জন্য। এটি সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীকে বেশি নমনীয়তা দেয়, যার ফলে তারা সাক্ষাৎকারের সময় আরো বিস্তারিত, ব্যক্তিগত বা কাস্টমাইজড প্রশ্ন করতে পারেন। এই ধরনের সাক্ষাৎকার সাধারণত বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যবহৃত হয় যেখানে কিছু নির্দিষ্ট বিষয় ছাড়াও নতুন তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করা হয়।
উদাহরণ: একটি মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত গবেষণায় একজন থেরাপিস্ট একজন রোগীর সাথে সেমি-স্ট্রাকচারড সাক্ষাৎকারে তাঁর অনুভূতি, অভিজ্ঞতা, এবং রোগের ইতিহাস জানতে চেষ্টা করেন।
৩. আনস্ট্রাকচারড (Unstructured) সাক্ষাৎকার:
আনস্ট্রাকচারড বা অবকাঠামোগত সাক্ষাৎকারে কোনো নির্দিষ্ট বা পূর্বনির্ধারিত প্রশ্ন থাকে না। এটি সম্পূর্ণরূপে মুক্ত আকারে থাকে এবং সাধারণত আলোচনা বা কথোপকথনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এতে সাক্ষাৎকারপ্রার্থী তাদের অভিজ্ঞতা, মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গি স্বাভাবিকভাবে ব্যক্ত করতে পারেন। এই ধরনের সাক্ষাৎকারটি সাধারণত গবেষকদের জন্য উপকারী, যারা সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহের চেয়ে গভীর বা ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি প্রাপ্তি চায়।
উদাহরণ: একজন গবেষক কোন বিষয়ে তার গবেষণার আওতায় সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন এবং সাক্ষাৎকারপ্রার্থীকে তাদের চিন্তাভাবনা ও মতামত ব্যক্ত করার জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে।
৪. ফোকাসড গ্রুপ সাক্ষাৎকার (Focus Group Interview):
ফোকাসড গ্রুপ সাক্ষাৎকারে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি একত্রিত হয়ে একটি নির্দিষ্ট বিষয় বা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। এটি একটি গ্রুপ আলোচনার আকার নেয় যেখানে একটি গাইডলাইন বা প্রশ্নপত্র থাকলেও অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারে। এই ধরনের সাক্ষাৎকারের মূল উদ্দেশ্য হল একটি ভিন্ন ভিন্ন মতামত বা ধারণা সংগ্রহ করা এবং সেই আলোচনার মাধ্যমে তথ্য বিশ্লেষণ করা।
উদাহরণ: একটি নতুন পণ্যের বাজারজাতকরণের জন্য বিভিন্ন গ্রাহকদের মধ্যে একটি ফোকাসড গ্রুপ আলোচনা।
৫. লাইভ (Life) সাক্ষাৎকার:
লাইভ বা জীবনকাহিনী সাক্ষাৎকার একটি ব্যক্তিগত, দীর্ঘ এবং গভীর সাক্ষাৎকার, যেখানে একজন ব্যক্তি তার জীবনকাহিনী এবং অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। এই ধরনের সাক্ষাৎকারে একজন সাক্ষাৎকারপ্রার্থী তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং ব্যক্তিগত অনুভূতি শেয়ার করেন। এটি সাধারণত আত্মজীবনী বা সামাজিক গবেষণায় ব্যবহৃত হয়।
উদাহরণ: একজন প্রবীণ ব্যক্তির জীবনের বিভিন্ন ঘটনা বা সংগ্রামের ওপর একটি সাক্ষাৎকার।
সাক্ষাৎকারের প্রক্রিয়া:
সাক্ষাৎকার একটি পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়া, যা সাধারণত নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করে:
১. প্রস্তুতি:
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীকে প্রথমে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হয়। এই প্রস্তুতিতে সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করা, প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তৈরি করা এবং সাক্ষাৎকারের পরিবেশ তৈরি করা অন্তর্ভুক্ত থাকে। এটি গুরুত্বপূর্ণ যে, সাক্ষাৎকারের প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলি স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়।
২. প্রশ্ন তৈরি:
সাক্ষাৎকারের জন্য প্রশ্ন তৈরি করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। প্রশ্নগুলি সুসংগত, নির্দিষ্ট এবং প্রাসঙ্গিক হতে হবে, যাতে তারা সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীকে তাদের অভিজ্ঞতা বা মতামত প্রকাশ করতে সহায়তা করে।
৩. সাক্ষাৎকার গ্রহণ:
এটি সাক্ষাৎকারের মূল অংশ, যেখানে সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী প্রশ্ন করেন এবং সাক্ষাৎকারপ্রার্থী তাদের উত্তর দেন। সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীকে উচিত একটি বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা এবং নিশ্চিত করা যে সাক্ষাৎকারপ্রার্থী সঠিকভাবে তাদের উত্তর দিতে সক্ষম হবেন।
৪. তথ্য সংগ্রহ:
সাক্ষাৎকারের সময় তথ্য সংগ্রহ করা হয় যা গবেষণার উদ্দেশ্য পূরণে সহায়তা করবে। এটি মৌখিক, শাব্দিক বা ভিডিও রেকর্ডের মাধ্যমে হতে পারে।
৫. বিশ্লেষণ:
এটি সাক্ষাৎকারের পরবর্তী ধাপ যেখানে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষকরা সাধারণত নির্দিষ্ট নিদর্শন বা বিষয়গুলি চিহ্নিত করেন এবং গবেষণার প্রশ্নের উত্তর বের করার চেষ্টা করেন।
সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্য এবং প্রয়োজনীয়তা:
সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্য প্রধানত তথ্য সংগ্রহের জন্য, যা গবেষণায় প্রয়োজনীয়। এটি বিভিন্ন গবেষণা ক্ষেত্রে যেমন, সামাজিক গবেষণা, মনোবিজ্ঞান, সাংবাদিকতা, শিক্ষা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য আরও গভীর এবং বৈচিত্র্যময় হতে পারে, কারণ এটি প্রত্যক্ষ এবং মুখোমুখি যোগাযোগের মাধ্যমে হয়।
উপসংহার:
সাক্ষাৎকার হলো একটি অত্যন্ত কার্যকর এবং বহুল ব্যবহৃত তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি। এটি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে এবং বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন উদ্দেশ্য পূরণে সহায়তা করে। তবে, সাক্ষাৎকারের জন্য প্রস্তুতি এবং সঠিক প্রশ্নের নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমে সঠিক এবং বিশ্লেষণযোগ্য তথ্য সংগ্রহ সম্ভব।