সত্য সমাজ তার সদস্যদের আচার-আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণের পন্থা ও পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। সমাজতত্ত্ববিদদের মধ্যে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রকারভেদ নিয়ে বিভিন্ন মতপার্থক্য রয়েছে। সাধারণত সামাজিক নিয়ন্ত্রণকে বিধিবদ্ধ (Formal) এবং অবিধিবদ্ধ (Informal) এই দু’টি মূল শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। বিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রণ পীড়নমূলক বা বলপ্রয়োগমূলক। অপরদিকে অরিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রণ হলো নরমসরম বা পরামর্শ প্রদানমূলক। সামাজিক এই শ্রেণিবিভাজনকে অনেকেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন। এই শ্রেণিকরণ সারাবিশ্বেই প্রচলিত। আবার সামাজিক নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি-প্রক্রিয়াকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক এই দুইভাগেও বিভক্ত করা হয়। ইতিবাচক সামাজিক নিয়ন্ত্রণ সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিকভাবে সমাজের নিয়মকানুন মেনে চলার প্রবণতা তৈরি করে। আর ইতিবাচক সামাজিক নিয়ন্ত্রণ যখন কার্যকরী হয় না তখন বাধ্য হয়েই নেতিবাচক সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কার্যকরী করতে হয়। এগুলি মূলত শাস্তিমূলক।
যেমন-অর্থদণ্ড, নিন্দা, সমালোচনা, তিরস্কার, শারীরিক আঘাত প্রভৃতি। অন্যদিকে টি. বি. বটোমোর সামাজিক নিয়ন্ত্রণকে প্রত্যক্ষ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও পরোক্ষ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এই দুইভাগে ভাগ করেছেন। প্রত্যক্ষ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বলতে আইন, ধর্মীয় অনুশাসন, পুলিশ প্রশাসন প্রভৃতিকে বোঝায়। অন্যদিকে পরোক্ষ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বলতে নীতিবোধ, মূল্যবোধ, আদর্শ প্রভৃতিকে বোঝায়। আবার সমাজতাত্ত্বিক লুমলে সামাজিক নিয়ন্ত্রণকে দুইভাবে ভাগ করেছেন। এগুলি হলো শক্তিমূলক ও প্রতীকমূলক। প্রথমটি শক্তিপ্রয়োগের উপর যথার্থভাবে নির্ভরশীল ও প্রতীকমূলক বলতে, অপমান, তিরস্কার, নিন্দা পুরস্কার প্রভৃতিকে বোঝায়। বার্নার্ড লুথার তিন ধরনের স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন। এই তিন ধরনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হলো- সচেতন ও অসচেতন, শোষণমূলক ও গঠনমূলক এবং ইতিবাচক ও নেতিবাচক সামাজিক নিয়ন্ত্রণ। সমাজতাত্ত্বিক হর্টন এবং হান্ট দুইভাগে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন- • পরিকল্পিত, অপরিকল্পিত। অন্যদিকে লাপিয়েরও দুই ধরনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন। কর্তৃত্বমূলক সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এবং গণতান্ত্রিক সামাজিক নিয়ন্ত্রণ। সমাজবিজ্ঞানী গুরভিজ ও ম্যুর তিন ধরনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন- (ক) সংগঠিত, (খ) অসংগঠিত, (গ) স্বাভাবিক।
তাই পরিশেষে এটা বলা যায়, কোন ধরনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ সমাজে কোথায় বলবৎ হবে বা কার্যকর হবে তা সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের তথা মানসিক প্রকৃতি, আচার-ব্যবহার, সামাজিক মাধ্যমগুলির গ্রহণযোগ্যতা ও সমস্যার প্রকৃতির উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল।