স্বামী বিবেকানন্দের “বাঙ্গালা ভাষা” প্রবন্ধ-এ তিনি বাংলার ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর দৃষ্টি দিয়েছেন এবং তা কীভাবে উদ্ভাসিত হতে পারে, সে বিষয়টি আলোকপাত করেছেন। তিনি বাংলার ভাষা এবং তার সংস্কৃতির সার্বিক উন্নতি ও সংরক্ষণের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা পেশ করেছেন। এই প্রবন্ধে স্বামী বিবেকানন্দ বিশেষভাবে পূর্ববাংলার চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষাকে ভবিষ্যতের আদর্শ বাঙ্গালা ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন।
স্বামী বিবেকানন্দের ভাষা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি:
প্রবন্ধে স্বামী বিবেকানন্দ বাংলার ভাষার ঐতিহ্য, তার উন্নতি এবং তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করেন। তিনি ভাষাকে একটি জাতির আত্মার প্রতিফলন হিসেবে দেখেন। বাংলার ভাষার প্রতি তার অনুরাগ এবং গভীর শ্রদ্ধা ছিল, তবে তিনি তা আরও উন্নত এবং সুন্দর করার জন্য কিছু দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন।
স্বামী বিবেকানন্দের মতে, বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব এবং আদর্শের জন্য প্রাকৃত ভাষার প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মনে করেন যে, চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষা-এর মধ্যে প্রাকৃত ভাষার মৌলিক বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে, যা বাংলাকে তার প্রকৃত আদর্শরূপে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করবে। তিনি চট্টগ্রামের ভাষাকে বাংলার ভবিষ্যতের আদর্শ ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করার পেছনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ উল্লেখ করেছেন।
চট্টগ্রামের ভাষার আদর্শতা:
স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষা এখনও তার মৌলিকতার মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেখানে প্রাকৃত ভাষার মাধুর্য এবং গাঁথুনির সৌন্দর্য অক্ষুণ্ন। এই অঞ্চলের ভাষা, তার ঐতিহ্য এবং সরলতা, স্বাভাবিকতা বাংলার অন্যান্য উপভাষাগুলোর তুলনায় অনেক বেশি পরিশুদ্ধ এবং সহজবোধ্য। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এই ভাষার মধ্যে বাংলার অন্তর্নিহিত প্রকৃতি এবং চরিত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
বঙ্গালীর ভবিষ্যতের জন্য প্রাকৃত ভাষার গুরুত্ব:
স্বামী বিবেকানন্দ ভাষার মধ্যে যে প্রাকৃত আদর্শ খুঁজে পেয়েছেন, তা তিনি বাঙালির মৌলিক চিন্তা-ভাবনা এবং বিশ্ববোধকে প্রকাশ করার জন্য অত্যন্ত উপযোগী মনে করেছেন। তিনি মনে করতেন যে, যখন বাংলা ভাষা সম্পূর্ণভাবে তার প্রকৃত আঙ্গিক এবং রূপ ধারণ করবে, তখন তা শুধু ভাষার ক্ষেত্রে নয়, পুরো বাংলার সংস্কৃতি ও চিন্তার ক্ষেত্রেও এক নতুন যুগের সূচনা হবে। চট্টগ্রামের ভাষার ঐতিহ্য, যে প্রাকৃত প্রভাব ধারণ করেছে, তা বাংলার গঠনমূলক রূপকে আরও প্রাঞ্জল এবং প্রাকৃতির প্রতি আস্থা তৈরি করবে।
বাংলার উচ্চারণ এবং শব্দের গঠন:
স্বামী বিবেকানন্দ বাংলার ভাষার শব্দের গঠন, উচ্চারণ, এবং তার মৌলিক সৌন্দর্য নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করেন। তার মতে, বাংলার ভাষায় প্রচুর ভিন্ন ভিন্ন উপভাষার সংমিশ্রণ হয়েছে, কিন্তু চট্টগ্রামের ভাষার উচ্চারণ এবং গঠন আরও প্রকৃত এবং সহজ। এর মাধ্যমে তিনি ভাষার নির্ভুলতা এবং প্রাকৃত সৌন্দর্য বজায় রাখার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
ভাষার সামাজিক ভূমিকা:
স্বামী বিবেকানন্দ ভাষাকে কেবল একটি যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে দেখেননি, বরং তিনি এটি একটি জাতির সামাজিক ঐক্য এবং সাংস্কৃতিক গৌরব হিসেবে দেখেছিলেন। তার মতে, একটি জাতির মধ্যে ভাষার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে তারা নিজেদের সত্ত্বা, নিজস্বতা এবং ঐতিহ্যকে বজায় রাখতে পারে। বাংলার উন্নতি এবং তার সমৃদ্ধির জন্য ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম ছিল এবং স্বামী বিবেকানন্দ চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষাকে সেই প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক একতা প্রতিষ্ঠার আদর্শ হিসেবে মানতেন।
বাংলার ভাষার আধুনিকীকরণ:
প্রবন্ধে স্বামী বিবেকানন্দ আরও এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন যে, বাংলা ভাষাকে শুধু আঞ্চলিকতা বা ঐতিহ্যগত কাঠামোতে আটকে রাখা উচিত নয়, বরং তার আধুনিকীকরণ এবং বিশ্বজনীনতা নিশ্চিত করতে হবে। তবে চট্টগ্রামের ভাষাকে তিনি আদর্শ রূপে চিহ্নিত করেছেন, কারণ এই ভাষা, তার মতে, বাংলা ভাষার সহজবোধ্যতা এবং ন্যাচারাল সৌন্দর্য ধরে রাখতে সবচেয়ে সক্ষম। তিনি চট্টগ্রামের ভাষার গঠন এবং সরলতাকে আধুনিক বাংলা ভাষার ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
উপসংহার:
স্বামী বিবেকানন্দের “বাঙ্গালা ভাষা” প্রবন্ধে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষার প্রতি তার বিশেষ মনোযোগ এবং ভবিষ্যতের আদর্শ ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। তার মতে, চট্টগ্রামের ভাষার মধ্যে প্রাকৃত ভাষার সহজতা, সৌন্দর্য এবং ঐতিহ্য বিদ্যমান, যা বাংলা ভাষার আধুনিকীকরণের প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। এভাবে, তিনি ভাষার মধ্যে শুদ্ধতা, প্রাকৃত সৌন্দর্য এবং চিন্তা-ভাবনার গভীরতা অর্জনের জন্য চট্টগ্রামের ভাষাকে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।