হরপ্পার নগর পরিকল্পনা-
হরপ্পা সভ্যতা (Indus Valley Civilization), যা সিন্ধু সভ্যতা নামেও পরিচিত, পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং উন্নত সভ্যতা ছিল। এই সভ্যতা খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০০-১৯০০ অবধি বর্তমান পাকিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের কিছু অংশে বিস্তৃত ছিল। হরপ্পার নগর পরিকল্পনা এবং শহর নির্মাণ কৌশল তাদের উন্নত সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরের পরিচয় দেয়। এটি শুধুমাত্র তাদের বাস্তব জীবনের উপযোগিতা নিশ্চিত করেছিল, বরং শহরের বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, এবং সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
এই নিবন্ধে আমরা হরপ্পার নগর পরিকল্পনা, তার বৈশিষ্ট্য এবং এর সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করব।
১. নগর পরিকল্পনার সাধারণ বৈশিষ্ট্য
হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা একটি অত্যন্ত সুসংগঠিত এবং সুদৃঢ় কাঠামো ছিল। প্রতিটি শহর সাধারণত একটি গাণিতিক ভিত্তিতে পরিকল্পিত ছিল, যার মধ্যে ছিল সঠিক রাস্তা, জলবদ্ধতার ব্যবস্থাপনা, আবাসন এবং অন্যান্য নগর সুবিধা। এর মধ্যে বেশ কিছু মূল বৈশিষ্ট্য ছিল:
১.১. নির্দিষ্ট রাস্তাঘাটের পরিকল্পনা
হরপ্পা শহরগুলির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল এর রাস্তা ও গলির পরিকল্পনা। শহরের রাস্তা ছিল একেবারে সোজা, প্রশস্ত এবং একে অপরকে সঠিক কোণে মিলিত হতো। এটি মূলত 90° কোণে একটি গ্রিড প্যাটার্ন অনুসরণ করত। রাস্তা এবং গলির এই সোজাসুজি পরিকল্পনা শহরের পরিবহন ব্যবস্থা এবং নাগরিকদের চলাচলের সুবিধা নিশ্চিত করেছিল। বড় বড় প্রধান রাস্তাগুলির পাশাপাশি আরও ছোট গলি ও উপপথ ছিল, যা বিভিন্ন অঞ্চলে গমনাগমন সুবিধা প্রদান করত।
১.২. পরিচ্ছন্নতা এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা
হরপ্পা সভ্যতা বিশেষভাবে পরিচ্ছন্নতা এবং পয়ঃনিষ্কাশনের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিল। শহরের সড়ক এবং বাড়ির মধ্যে একটি সুশৃঙ্খল পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল, যা আজকের দিনে আধুনিক শহরের সাথে তুলনীয়। প্রতিটি বাড়ির মধ্যে এক ধরনের ব্যক্তিগত স্যুয়ার সিস্টেম ছিল, যার মাধ্যমে আবর্জনা ও বৃষ্টির পানি বাইরে নিয়ে যাওয়া হতো। শহরের রাস্তার পাশে পাকা খাল ছিল, যা পানি বের করে শহরের বাইরে প্রবাহিত করত।
১.৩. অবস্থান এবং স্থাপত্য পরিকল্পনা
হরপ্পা নগরগুলি বড়, স্থিতিশীল এবং পরিকল্পিত ছিল। শহরগুলির বড় ভবনগুলি সাধারণত ইট দিয়ে নির্মিত হত, যা আধুনিক শহরের বিশাল স্থাপত্যের সাথে তুলনীয়। বাসস্থানগুলি ছিল নিয়মিত আকৃতির, এবং তারা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল বা এলাকায় বিভক্ত ছিল, যেমন বাণিজ্য এলাকা, আবাসিক অঞ্চল, এবং ধর্মীয় বা প্রশাসনিক এলাকা।
১.৪. নগর বিভাজন
হরপ্পা শহরগুলি সাধারণত দুটি প্রধান অঞ্চল ছিল:
- উচ্চ এলাকা (Citadel): এটি শহরের প্রশাসনিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র ছিল। এখানে প্রাসাদ, বড় পুকুর এবং কিছু বিশেষ স্থানীয় নির্মাণ ছিল।
- নিম্ন এলাকা (Lower City): এই এলাকাটি সাধারণত বসবাসকারী মানুষের জন্য এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য ব্যবহৃত হত।
১.৫. কোণাকোণি বিন্যাস
হরপ্পা শহরের বাড়িগুলি একে অপরের কাছাকাছি স্থাপিত ছিল এবং তাদের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রাখা হত। ঘরগুলির মধ্যে দেওয়াল এবং ছাদে এক ধরনের সমন্বয় ছিল, যা একটি কার্যকরী ও পরিকল্পিত পরিবেশ তৈরি করেছিল।
২. জল সরবরাহ এবং সেচ ব্যবস্থা
হরপ্পা সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল তার উন্নত জল সরবরাহ এবং সেচ ব্যবস্থা। শহরের মধ্যে বিভিন্ন পুকুর, ঝিল এবং জলাশয় ছিল, যা নাগরিকদের পানি সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত হত। এছাড়া, কিছু শহরে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং ব্যবস্থাও ছিল, যা বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে বিভিন্ন ব্যবহারযোগ্য জায়গায় নিয়ে আসা হতো।
শহরের বাড়ির ভিতরে এবং বাইরে একাধিক জলাধার ছিল, যা নিত্যদিনের জীবনের প্রয়োজনীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা করত। এছাড়া, শহরের বাইরের অঞ্চলেও কৃষির জন্য উন্নত সেচ ব্যবস্থা ছিল, যা মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করত। হরপ্পার কৃষি ব্যবস্থা উন্নত ছিল, এবং এটি নগর পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।
৩. আবাসিক পরিকল্পনা
হরপ্পা নগরের আবাসিক ভবনগুলি সাধারণত একতলা বা দু’তলা ছিল। বেশিরভাগ বাড়িই ছিল ছোট, তবে কিছু বড় বাড়ি বা প্রাসাদও পাওয়া গেছে, যা সম্ভবত উচ্চ শ্রেণীর মানুষদের জন্য ছিল। বাড়িগুলি সাধারণত ইট দিয়ে নির্মিত ছিল, এবং তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ আঙ্গিনা বা উঠোন ছিল, যেখানে পরিবারগুলি তাদের দৈনন্দিন জীবন যাপন করত। বাড়ির মধ্যে ছিল প্রয়োজনীয় সুবিধা, যেমন রান্নাঘর, জলাধার এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা।
৪. হরপ্পা নগরগুলির সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট
হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা এবং নির্মাণ কৌশলগুলি শুধুমাত্র তাদের বাস্তব জীবনকে সহজ করে তুলেছিল, বরং এটি তাদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোরও প্রতিফলন ছিল। শহরগুলির মধ্যে বাণিজ্যিক এলাকা, শিল্পাঞ্চল এবং ধর্মীয় বা প্রশাসনিক এলাকা নির্ধারিত ছিল।
৪.১. বাণিজ্য এবং শিল্পকলা
হরপ্পা সভ্যতায় শিল্প এবং বাণিজ্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে মুদ্রা, ভারী পণ্য, পাথর, মণি এবং অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ব্যবহৃত হত। শহরের বিভিন্ন অংশে বাণিজ্যিক কার্যক্রম এবং বাজারের ব্যবস্থা ছিল, যেখানে লোকেরা একে অপরের সাথে পণ্য বিনিময় করত।
৪.২. ধর্মীয় ও প্রশাসনিক কেন্দ্র
হরপ্পার উচ্চ এলাকায় বড় ধর্মীয় বা প্রশাসনিক ভবন ছিল, যা তাদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করত। এটি একদিকে শহরের কেন্দ্রীকৃত শাসন এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতিফলন, অন্যদিকে একটি সুসংগঠিত প্রশাসনিক ব্যবস্থার জন্য ভিত্তি ছিল।
৫. পরিসংখ্যান এবং প্রযুক্তি
হরপ্পা সভ্যতার মাপ এবং প্রযুক্তি অত্যন্ত উন্নত ছিল। তাদের মাপের ইউনিটগুলি সুষম ছিল এবং এটি শহরের নির্মাণ এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রাচীন সময়ে, হরপ্পা নগরগুলিতে ব্যবহৃত প্রযুক্তি এবং মাপের দক্ষতা তাদের উন্নত সাংস্কৃতিক চেতনা এবং প্রতিষ্ঠিত শাসনব্যবস্থার সাক্ষী।
উপসংহার
হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা একটি অসাধারণ উদাহরণ যা তার সময়ের উন্নততা, সাংস্কৃতিক প্রজ্ঞা এবং সামাজিক কাঠামোকে প্রতিফলিত করে। আধুনিক নগর পরিকল্পনার অনেক মৌলিক ধারণা, যেমন রাস্তাঘাটের সোজাসুজি পরিকল্পনা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, এবং জল সরবরাহের পরিকল্পনা হরপ্পা সভ্যতা থেকেই উদ্ভূত। এই সভ্যতা প্রমাণ করে যে, প্রাচীন মানুষের নগর নির্মাণে উন্নত প্রযুক্তি এবং সংগঠিত চিন্তা ছিল, যা আজকের আধুনিক শহরের ভিত্তি স্থাপন করেছে।