ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতার প্রথম নিদর্শন সিন্ধু উপত্যকায় আবিষ্কৃত হয়। সেই হিসেবে ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতা হিসেবে সিন্ধু সভ্যতা বিশেষভাবে পরিচিত। এই সভ্যতা হল মিশরীয় ও মেসোপটেমীয় সভ্যতার সমসাময়িক।
1921-22 সালে জন মার্শালের নেতৃত্বে দয়ারাম সাহানি ও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় পাকিস্তানের অন্তর্গত মন্টগোমারি জেলায় হরপ্পা ও সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় মহেন-জো-দারো নামক দুটি সভ্যতার আবিষ্কার করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, চার্লস ম্যাসন 1826 খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম হরপ্পার অস্তিত্বের কথা বলেন।
1853 ও 1873 খ্রিস্টাব্দে প্রত্নতত্ত্ববিদ আলেকজান্ডার ক্যানিংহাম হরপ্পা সভ্যতা পরিদর্শন করেন এবং তার উৎসাহে এই সভ্যতার খননকার্য শুরু হয়। হরপ্পার নিদর্শনগুলি মহেন-জো-দারো অপেক্ষা প্রাচীনতর ও বৃহত্তর। তাই অধিকাংশ ঐতিহাসিক এই সভ্যতাকে হরপ্পা সভ্যতা হিসেবে বিবেচনা করেন। আবার সিন্ধু নদীর উপত্যকায় এই সভ্যতার শহর-নগর বিস্তৃতির জন্য এটি সিন্ধু সভ্যতা হিসেবেও সর্বাধিক পরিচিত।
হরপ্পা সভ্যতার উৎপত্তি:
সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে অন্যতম সমস্যা হল এই সভ্যতার উৎপত্তি বিষয়ক সমস্যা। সিন্ধু সভ্যতার অষ্টা হিসেবে সুমের সভ্যতা, দ্রাবিড় সভ্যতা, আর্য সভ্যতা সংক্রান্ত তত্ত্বের কথাগুলি জানা যায়। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার উৎপত্তি সংক্রান্ত তত্ত্বগুলি হল-
• সুমের সভ্যতা সংক্রান্ত তত্ত্ব:
ঐতিহাসিক মার্টিমার হুইলার লিখেছেন যে, সিন্ধুবাসীর খাদ্যশস্য উৎপাদন, বন্ধুবয়ন, নগর নির্মাণ, ধাতুর ব্যবহার প্রভৃতি বিষয়গুলি সুমেরু সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত। তিনি সিন্ধু সভ্যতার উৎপত্তি সংক্রান্ত তত্ত্ব হিসেবে সুমের সভ্যতার অবদানকে স্বীকার করেন। গর্ডন চাইল্ড অবশ্য ভিন্ন মত পোষণ করে বলেছেন যে, উভয় সভ্যতার মধ্যে ভাস্কর্য, মুৎকর্ম ও লিপির দিক দিয়ে ব্যবধান বিদ্যমান ছিল। হরপ্পার সিলমোহর সুমের থেকে পৃথক ছিল।
• দ্রাবিড় তত্ত্ব:
দ্রাবিড়রা সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা-এই অভিমতের পক্ষে বলা হয় প্রাক বৈদিক যুগে দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মানুষই সারা ভারতে অবস্থান করত। সেই জন্য উত্তর-পশ্চিম ভারতে তাদের অবস্থান অস্বাভাবিক ছিল না। উল্লেখ্য, বালুচিস্তানের ব্রাহ্ই জাতি ছিল দ্রাবিড় গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। সিন্ধু উপত্যকায় যে নরকঙ্কালগুলি পাওয়া গেছে সেগুলি পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে সেখানে এক মিশ্র নরগোষ্ঠীর অবস্থান ছিল।
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড, মালয়েড, আল্পনীয় এবং ভূমধ্যসাগরীয় জনগোষ্ঠীর বংশধর ছিল সিন্দু অধিবাসীরা। ধর্মের দিক থেকে সিন্ধুবাসীদের সঙ্গে দ্রাবিড় সভ্যতার যথেষ্ট সাদৃশ্য লক্ষ করা গেছে। উভয়েই শিবশক্তি ও লিঙ্গ পুজা করত। অতএব দ্রাবিড়রাই হল সিন্ধু সভ্যতার অষ্টা। এই সিন্ধান্তের বিপক্ষে বলা যায় যে, উভয় সভ্যতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও স্থাপত্যকর্মে যথেষ্ট পার্থক্য ছিল।
• আর্যতত্ত্ব:
একসময় মনে করা হত আর্যরাই সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ বলেছেন, ‘সিন্ধু সভ্যতার শিকড় বৈদিক যুগ থেকে দেখা যায়।’ ঋগ্বেদের পর্বে আর্যদের ভারতে আসার পূর্বে কয়েকটি ইন্দো-আর্য উপজাতি সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলে এসে তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল। সিন্ধু ধর্ম-সাধনা পরবর্তীকালের বৈদিক পর্বের ব্রাহ্মণ্য ধর্ম-সাধনার সঙ্গে সম্পর্কিত।
ঐতিহাসিক গর্ডন চাইল্ড, মার্টিমার হুইলার উপরোক্ত মতটি অস্বীকার করে বলেন আর্য সভ্যতা হল গ্রামীণ কিন্তু সিন্ধু সভ্যতা নগরকেন্দ্রিক। সিন্ধু সভ্যতায় লোহার প্রচলন ছিল না কিন্তু আর্যরা লোহার ব্যবহার জানত। সিন্ধু সভ্যতায় মৃত ব্যক্তিদের সমাধিস্থ করা হত কিন্তু আর্য সভ্যতায় মৃত ব্যক্তিকে পুড়িয়ে দেওয়া হত। এ ছাড়া আর্যরা নগর সভ্যতার স্রষ্টা নয় বরং নগর সভ্যতার ধ্বংসকর্তা। এই যুক্তি সূত্রে স্পষ্ট হয় যে, আর্য উপজাতিগুলি সিন্ধু উপজাতির সমগোত্রীয় নয়।
• করোচি তত্ত্ব:
নৃতাত্ত্বিক উপাদানের ওপর ভিত্তি করে অর্থাৎ, হরপ্পা ও মহেন-জো-দারো-তে প্রাপ্ত করোটিগুলি পরীক্ষানিরীক্ষা করে চারটি গোষ্ঠীর পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন-অস্ট্রিক, মঙ্গোলীয়, ভূমধ্যসাগরীয় ও আলপাইন।
সুতরাং, মনে করা হয় যে, সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিল কোনো এক বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর দ্বারা নয়। বিভিন্ন জাতির যৌথ প্রচেষ্টায় বিশেষভাবে আর্য-অনার্য জাতীর সংমিশ্রণে এই সভ্যতায় উন্মেষ হয়েছিল। হরপ্পা সভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটিয়েছিল ভারতীয় আবিষ্কারগণ। ঐতিহাসিক ব্যাসাম হরপ্পা সংস্কৃতির দেশীয় উৎসে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতে, হরপ্পার উন্মেষের পশ্চাতে ভারতীয় মানসিকতা কাজ করেছিল।