হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা কারা:
প্রাচীন বিশ্বে হরপ্পা সভ্যতার মতো এমন একটি উন্নত সভ্যতার স্রষ্টা কারা এ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। এ বিষয়ে মূলত চারটি মত রয়েছে, যথা- ① সুমেরীয়, দ্রাবিড়, আর্য ও অন্যান্য জাতি, যেমন-অসুর, নাগ, পণি, ব্রাত্য, দাস প্রভৃতি। এই মতের কথা বলা হয় যে, এরাই হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা, তবে হরপ্পার লিপি পাঠোদ্ধার না হওয়া অবধি তাদের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ থেকেই যায়।
• সুমেরীয়:
স্যার মর্টিমার হুইলার, গর্ডন চাইল্ড প্রমুখ মনে করেন মেসোপটেমিয়া বা সুমেরুর লোকেরাই হরপ্পা সভ্যতা সৃষ্টি করেছিল। এ সময় দুই সভ্যতার নগর জীবন, কৃষিকার্য, পশুপালন, ধাতুবিদ্যা, বস্ত্রবয়ন, ইট ও পাথরের কাজ প্রভৃতি নানা বিষয়ের সাদৃশ্য লক্ষ করে তারা এই মত দিয়েছেন। হুইলার বলেন যে, হরপ্পা সংস্কৃতি সুমেরীয় সভ্যতার কাছে ঋণী এবং সুমেরীয় সভ্যতাই সিন্ধু অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়েছিল মাত্র। গর্ডন চাইল্ড-এর মতে, উভয় সভ্যতার শিকড় এক। কিন্তু জন মার্শাল, এ এল ব্যাসাম প্রমুখ এই মত স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে, মৃতদেহ সৎকার, খাদ্যরীতি, মৃৎপাত্র, সিলমোহর, লিপি, নারীদের কেশবিন্যাস প্রভৃতি দিক থেকে উভয় সভ্যতার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। তাই মার্শাল, ব্যাসাম প্রমুখ মনে করেন যে, বিদেশি কোনো প্রভাব নয় স্থানীয় সংস্কৃতিই হরপ্পা সভ্যতার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। অলচিন দম্পতিও মনে করেন, বৈদেশিক প্রভাব অপেক্ষা স্থানীয় সংস্কৃতিই ছিল হরপ্পা নগরগুলির উদ্ভবের স্তম্ভ।
• দ্রাবিড়:
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রেভারেন্ড হেরাস, ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. এ এল ব্যাসাম প্রমুখ দেশি-বিদেশি ঐতিহাসিকের মতে, দ্রাবিড় জাতিই হল হরমা সভ্যতার স্রষ্টা। কারণ- দ্রাবিড়রা একসময় উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে বাস করত। ③ ঋগবেদে বলা হয়েছে আর্যরা একটি অনার্য জাতিকে পরাজিত করেছিল, এরা হল দ্রাবিড়। সিন্ধু লিপির সঙ্গে প্রাচীন তামিল লিপির যথেষ্ট মিল আছে। হরয়া সভ্যতার মতোই শিব, শক্তি, লিলা ও যোনি পুজা দ্রাবিড়দের মধ্যে প্রচলিত ছিল।
হরপ্পা সভ্যতার বেশ কিছু সংখ্যক কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল নদীর ধারে। 40টি জনবসতি গড়ে ওঠে সিন্ধুনদ ও তার শাখাপ্রশাখার তীরে এবং 1100টির মতো জনবসতি গড়ে উঠেছিল সিন্ধু ও গলার মধ্যবর্তী সমতল অঞ্চলে। এই অঞ্চল ছিল সরস্বতী অববাহিকায় অবস্থিত। বাকি কিছু জনবসতি গড়ে উঠেছিল গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে। সরস্বতীর পূর্ববাহিকায় জনবসতির প্রাধান্য লক্ষ করে কেউ কেউ হরপ্পা সভ্যতাকে ‘সরস্বতী সভ্যতা’ নাম দিয়েছেন।
হরল্লা সভ্যতার 1500টি কেন্দ্রের মধ্যে অধিকাংশই ছিল ছোটো-ছোটো গ্রাম, যাদের আয়তন 10 হেক্টরের বেশি নয়। মহেন-জো-দারো (250 হেক্টর), হরপ্পা (15 হেক্টর), কালিবঙ্গান (100 হেক্টর), ধোলাবিরা (100 হেক্টর) প্রভৃতি ছিল প্রকৃতি অর্থে বড়ো ③ জাঁ ফিলিওজা বলেন যে, প্রাক্-আর্য যুগে মুণ্ডা ও দ্রাবিড়রাই ছিল ভারতের প্রধান জনগোষ্ঠী, মুণ্ডাদের উন্নত সভ্যতা ছিল না, সুতরাং দ্রাবিড়রাই হরয়া সভ্যতার অষ্টা। বলাবাহুল্য, এই মতের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ উঠেছে। বলা হয় যে-① হরপ্পাবাসী ও দ্রাবিড়দের শব সৎকারের পদ্ধতি পৃথক, দ্রাবিড়রা যদি হরপ্পা সভ্যতার অষ্টা হত তাহলে দাক্ষিণাত্যে কোনো অনুরূপ সভ্যতা গড়ে উঠল না কেন? বেলুচিস্তানের বাহুই উপজাতির সঙ্গে দ্রাবিড়দের থেকে বেশি ইরানীয় মানুষদের মিল আছে। সুতরাং, দ্রাবিড়রা হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।
• আর্য:
এ ডি পুসলকার, এস আর রাও, অলচিন দম্পতি প্রমুখ দেশি-বিদেশি ঐতিহাসিক মনে করেন যে, আর্যরাই হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা। কারণ হিসেবে তারা উভয় সভ্যতার মানুষের খাদ্য, পোশাক, জীবজন্তু, বস্ত্রবয়ন, তুলোর চাষ, দেবদেবীর মিলের কথা বলেন। তবে গর্ডন চাইল্ড, জন মার্শাল, ব্যাসাম প্রমুখ ঐতিহাসিক অতি দৃঢ়তার সঙ্গে এই মতবাদ অস্বীকার করেছেন। জন মার্শাল বলেন যে, সিন্ধু সভ্যতা আর্য সভ্যতা অপেক্ষা প্রাচীন ও ভিন্ন প্রকৃতির আর্য সভ্যতা গ্রামীণ, কিন্তু হরয়া সভ্যতা নগরকেন্দ্রিক। আর্যরা লোহার ব্যবহার জানত, কিন্তু হরপ্পাবাসীরা লোহার ব্যবহার জানত না। ঘোড়া আর্যদের গৃহপালিত পশু ছিল কিন্তু হরপ্পাবাসীরা ঘোড়া চিনত না। হরপ্পাবাসীদের জীবিকা ছিল বাণিজ্য, কিন্তু আর্যদের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকাজ ও পশুপালন। এইসব কারণে জন মার্শাল সিন্ধু সভ্যতার অষ্টা হিসেবে আর্যতত্ত্ব বাতিল করে দিয়েছেন।
• অন্যান্য জাতি:
এ ব্যাপারে অনেকে পণি, অসুর, ব্রাত্য, দাস, নাগ প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর কথা বলে থাকেন। কিন্তু এই ব্যাপারে তথ্য এতই কম যে, এ সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো সম্ভব নয়।
চায়না হরপ্পা সভ্যতায় প্রাপ্ত নরকঙ্কালগুলির নৃতাত্ত্বিক পরীক্ষা করে এখানে প্রোটো অস্ট্রালয়েড, ভূমধ্যসাগরীয়, আলপাইন ও মোঙ্গলীয় এই চারটি জনগোষ্ঠীর মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, হরপ্পা সভ্যতা বিশেষ কোনো একটি জাতির দ্বারা সৃষ্ট নয়।
বরং বলা যায়, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সাহায্যে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এ ছাড়া মহেন-জো-দারোর নীচের জলমগ্ন স্তরগুলি পরীক্ষা করা সম্ভব হলে এবং সিন্দুলিপির পাঠোদ্ধারে সম্ভব হলে এই বিষয়ে কোনো নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো যাবে।