‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসের ব্রতী চরিত্রটির স্বরূপ উন্মোচন করো
‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসের ব্রতী চরিত্রটি একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং গভীরভাবে প্রতীকী চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। মহাশ্বেতা দেবী এই চরিত্রের মাধ্যমে একটি জটিল ও সংগ্রামী মানুষের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। ব্রতী চরিত্রটি উপন্যাসের মূল কাহিনির কেন্দ্রবিন্দু, এবং তার জীবন ও মৃত্যু সমাজের বিভিন্ন স্তরের অসাম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক।
ব্রতীর পরিচয় ও ব্যক্তিত্ব:
ব্রতী একজন যুবক, যে সমাজের অসাম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিশ্বাসী। তিনি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান এবং তার মা সুজাতার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে আদর্শবোধ, সাহস, এবং নিজের আদর্শের প্রতি গভীর বিশ্বাস। ব্রতী তার শিক্ষিত পরিবার থেকে প্রাপ্ত মূল্যবোধের বাইরে গিয়ে একটি নতুন আদর্শ অনুসরণ করতে চেয়েছে, যা তাকে সামাজিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে নিয়ে যায়।
রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি:
ব্রতী চরিত্রটি তার রাজনৈতিক চেতনা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নকশালবাড়ি আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন, যা ভারতের শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করছিল। ব্রতী একটি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি সমাজের শোষিত শ্রেণির জন্য একটি নতুন সমাজব্যবস্থা কল্পনা করেছিলেন, যেখানে সকলের জন্য সমান অধিকার থাকবে।
সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ:
ব্রতী একজন যোদ্ধা, যে নিজের জীবনের মুল্য দিতে প্রস্তুত ছিল তার আদর্শের জন্য। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সমাজের পরিবর্তন আনতে হলে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে এবং সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করতে হবে। ব্রতী তাঁর সংগ্রামে এতটাই নিবেদিত ছিলেন যে তিনি নিজের জীবনের বিনিময়েও তাঁর আদর্শের প্রতি অনুগত ছিলেন। এই আত্মত্যাগের মূলে ছিল সমাজের শোষণ ও অসাম্য দূর করার অঙ্গীকার।
মৃত্যু ও তার তাৎপর্য:
ব্রতীর মৃত্যু উপন্যাসের কেন্দ্রীয় ঘটনা এবং এটি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গভীর অর্থবহ। একদিকে, এটি একটি অকালপ্রয়াণ, যা তার আদর্শ ও স্বপ্নের অপূর্ণতার প্রতীক। অন্যদিকে, এটি তার আদর্শের প্রতি অবিচলতার এবং সংগ্রামের প্রতি তার অটুট প্রতিজ্ঞার প্রতীক। তার মৃত্যুর পরে, মা সুজাতার মধ্য দিয়ে আমরা সমাজের শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে তার সংগ্রামকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় প্রতীক:
ব্রতী শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি নয়, বরং একটি প্রতীক। তিনি সেই সমস্ত যুবকদের প্রতীক, যারা আদর্শের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে এবং সমাজের পরিবর্তনের জন্য লড়াই করে। তিনি শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের সংগ্রামের প্রতীক এবং তাঁর সংগ্রাম ও মৃত্যু সমাজের অবিচার ও অসাম্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
মোটকথা, ব্রতী চরিত্রটি ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসের একটি কেন্দ্রীয় ও প্রতীকী চরিত্র, যার মাধ্যমে মহাশ্বেতা দেবী সমাজের শোষণ, অসাম্য, এবং অবিচারের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বার্তা প্রদান করেছেন। ব্রতীর জীবন ও মৃত্যু সমাজের প্রতিটি স্তরের জন্য একটি প্রতিফলন এবং পরিবর্তনের জন্য একটি আহ্বান।