অর্থবিত্তে স্বচ্ছল হলেও পরনারীতে অভ্যস্থ হওয়ায় দিব্যনাথ-সুজাতার দাম্পত্য-সম্পর্ক সুখের ছিল না। দিব্যনাথ সুজাতাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতো না। বরং যৌন পার্টনার হিসেবেই বিবেচনা করত। অসুখবিসুখ হলে খোঁজখবর নিত না। নবজাতকের কান্না থেকে বাঁচার জন্য তেতলায় ঘুমাত। প্রসূতি স্ত্রী থেকে দূরে অবস্থান করত। শাশুড়িমাও ছিল নারীবিদ্বেষী মহিলা। সুজাতার সন্তান জন্মদান সইতে পারত না। প্রসবকাল দেখলেই বাড়ি ছেড়ে চলে যেত। তীব্র প্রসবযন্ত্রণা নিয়ে সুজাতাকে একা একাই নার্সিং হোমে যেতে হতো। দিব্যনাথের নজর কেবল একদিকে ‘আবার মা হবার যোগ্য শরীর হচ্ছে কি না সুজাতার।’ দুবছর পরপর সুজাতার চার সন্তান জন্মে। জ্যোতি, নীপা, তুলি। সর্বশেষ ব্রতী। প্রথম ও শেষে পুত্রসন্তান, মাঝখানে দুটি কন্যাসন্তান। ব্রতীর দুবছর বয়সকালে সুজাতা লম্পট দিব্যনাথের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ করেছিল। লেখকের ভাষায়-দিব্যনাথ কিছুতেই ওঁকে পঞ্চমবার ‘মা’ হতে বাধ্য করতে পারেনি। দিব্যনাথ সুজাতাকে ফার্মের কাজ ছেড়ে দিতে বলেছিল। সুজাতা মানেনি। ‘কাজ না-ছাড়া সুজাতার দ্বিতীয় বিদ্রোহ।’
বাবামায়ের মধ্যকার এই টানাপড়েন ব্রতী খানিকটা বুঝতে পারত। বুঝতে পারত মাতৃবক্ষের সুগভীরে লুকানো তীব্র গোপন ব্যথা। ব্রতীর মনটা কম্পাসের কাটার ন্যায় মমতাময়ী মাতা জগজ্জননী সুজাতার দিকে হেলে থাকত। ব্রতী সর্বদা মায়ের ওপর চোখদুটো সুস্থির রাখত। দশ বছর বয়সেও খেলাধুলা ফেলে বাড়ি চলে আসত। শিয়রে বসে মায়ের মাথায় বাতাস করত। এজন্য দিব্যনাথ ব্রতীকে সইতে পারত না। কনিষ্ঠ সন্তান হলেও শত্রু বিবেচনা করত। ব্রতীকে টিপ্পনি কেটে দিব্যনাথ কখনো বলত ‘মাদার্স চাইল্ড’ কখনো বলত ‘মেয়েমার্কা ছেলে। নো ম্যানলিনেস।
মতাদর্শিক দ্বন্দ্বে এই পুঁজিবাদী পরিবারের চরিত্রগুলো দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একদিকে পারিবারিক ‘বস’ দিব্যনাথ ও জ্যেষ্ঠ তিন সন্তান জ্যোতি, নীপা, তুলি। সেইসঙ্গে এদের পূর্বপ্রজন্ম ঠাকুরমাও। অপরদিকে সুজাতা ও তার কনিষ্ঠ সন্তান ব্রতী। এই দ্বন্দ্ব কেবল একটি পরিবারের নয়, এটি সমসাময়িক সমাজ অথবা রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব। এমনকি বৈশ্বিকও। বিশ্বজগৎ সংসার তখন ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দধারায় দ্বিধাবিভক্ত। দ্বন্দ্বটা এতই জটিল ছিল যে, ভাই-বোন, পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রীর সমুদয় সামাজিক ও আত্মিক বন্ধন শিথিল হয়ে যায়। এমনকি রক্তের বন্ধনও।