প্রাচীন উত্তরবঙ্গের নৃতাত্বিক পটভূমি
নৃতত্ত্ববিদদের মতানুযায়ী ভারতে সর্বপ্রথম নেগ্রিটো বা নিগ্রোবটু সম্প্রদায়ের মানুষদের আবির্ভাব ঘটে। এদের পর সাদি অস্ট্রেলীয় সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হয়। মধ্যভারতের কোল, ডিল, মুণ্ডা, ভূমিজ এবং মালপাহাড়ি প্রভৃতি জনজাতির মানুষেরা এই আদি অস্ট্রেলীয় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। বঙ্গ তথা রাঢ় অঞ্চলের সাঁওতাল, ভূমিজ, মুন্ডা, বাঁশফোড় প্রমুখও এই আদি অস্ট্রেলীয় শ্রেণির অন্তর্গত। ভূমধ্যসাগরীয় জাতির শাখা হিসেবে দ্রাবিড়রা দাক্ষিণাত্যের পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ ভারতে বসতি স্থাপন করে। কালক্রমে এরা উত্তর ভারতের অস্ট্রিকদের সঙ্গে মিশে যায় এবং বঙ্গেও স্থানান্তরিত হয়। মঙ্গোলীর নরগোষ্ঠীর সঙ্গেও ভারতবর্ষের ঘনিষ্ঠতর যোগাযোগ লক্ষ করা যায়। এরা আসাম, নেপাল, ভুটান, ব্রহ্মদেশ এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা প্রভৃতি অঞ্চলে বিস্তারলাভ করে। মঙ্গোলীয়দের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাধৃত একটি শাখা কালক্রমে রংপুর, কোচবিহার অর্থাৎ, পুণ্ড্রবর্ধন বা উত্তরবঙ্গে প্রবেশ করে।
উত্তরবঙ্গের নৃতাত্ত্বিক আলোচনার প্রসঙ্গে এ কথা বলা প্রয়োজনীয় যে. উত্তরবঙ্গ বলতে আধুনিককালে মালদহ, দক্ষিণ দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুর, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহার-এই হু-টি জেলা নিয়ে গঠিত একটি ভূখণ্ড বা প্রশাসনিক এলাকা বোঝালেও এর পূর্বনাম ছিল পুণ্ড্রবর্ধন না বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রী। পুণ্ড্রবর্ধন (উত্তরবঙ্গ), সমতট (পূর্ববঙ্গ), কমলঙ্কা (কুমিল্লা), তাএলিপ্ত (দক্ষিণবঙ্গ) এবং কর্ণসুবর্ণ (পশ্চিমবঙ্গ)-এই পাঁচটি অংশ নিয়ে গঠিত ছিল তৎকালীন বাদেশ। উত্তরবঙ্গের জনবিন্যাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় এবং আর্য-এই চারটি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষেরা প্রাচীনকাল থেকেই উত্তরবঙ্গ তথা পুণ্ড্রবর্ধনে বসবাস করে। নৃতাত্ত্বিক বিচারে কোচ রাজাগণ মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠী থেকে উদ্ভুত এবং অপরদিকে রাজবংশীগণ দ্রাবিড় নরগোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত। কোচ এবং রাজবংশী এই দুটি ভিন্ন জাতি এবং তাদের আকৃতি, ভাষা এবং আচার-ব্যবহার পৃথক ধরনের। তিব্বত ব্রহ্মভাষী কোচ, মেচ, বোড়ো, কাছারি, রাভা প্রভৃতি বিভিন্ন উপজাতির লোকেরা উত্তরবঙ্গে প্রবেশ ভরে এবং কালক্রমে দ্রাবিড় গোষ্ঠীর সঙ্গে সমন্বিত হয়। ঐতেরেয় ব্রাহ্মণ, মহাভারতের
আদিপর্ব, মৎস্য ও বায়ুপুরাণ প্রভৃতি উৎস থেকে প্রাচীন বাংলার তিনটি গোষ্ঠীর সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলি হল-পুণ্ড্র, বলা ও সূক্ষ্ম। এরা অনার্য গোষ্ঠীভুক্ত। বৈদিক সাহিত্য থেকে জানা যায় যে, বিভিন্ন জাতি ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী বঙ্গের বিভিন্ন অংশে বসবাস করত। নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ লক্ষ করা যায় যে. কোল, শবর, পুলিন্দ, হাদি, ডোম, চণ্ডাল এবং ম্লেচ্ছ প্রভৃতি বিভিন্ন আদিম উপজাতিগোষ্ঠী বঙ্গের বিভিন্ন অংশে বসবাস করত। এরাই ছিল বাংলার আদিম অধিবাসী। এই গোষ্ঠীর মানুষেরা ছিল অনার্য, যারা বৈদিক সাহিত্যে ‘নিষাদ’ নামে পরিচিত। রায়বাহাদুর রামপ্রসাদ চন্দ এই অনার্য গোষ্ঠীগুলির জাতিতাত্ত্বিক নাম দিয়েছেন ‘নিষাদ’। অন্যান্যদের মতে, তারা ছিল অস্ট্রো-এশিয়াটিক বা অস্ট্রীয়। প্রফেসর প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ তাঁর নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় বাংলার আধুনিক সাতটি জাতির কথা বলেছেন। এগুলি হল-ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, সদগোপ, কৈবর্ত, রাজবংশী, পড় এবং বাগদি। এদের মধ্যে কায়স্থ, সগোপ এবং কৈবর্ত ছিল বাংলার প্রাচীন জাতি।
প্রফেসর মহলানবিশের উপরোউক্ত নাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ছিল বাংলার জাতি মিশ্রণের ক্ষুদ্র পরিসরে একটি ব্যাখ্যা। স্যার হার্বার্ট রিজলে বিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে গবেষণার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, বাংলার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীগুলি আসলে দ্রাবিড়িয়ান এবং মঙ্গোলয়েড সম্প্রদায়ের। তবে রায়বাহাদুর রামাপ্রসাদ চন্দ সর্বপ্রথম রিজলের মঙ্গোলয়েড-দ্রাবিড়িয়ান কেন্দ্রিক বাংলার জনগোষ্ঠী উৎপত্তির তথ্যকে অস্বীকার করে বলেছেন যে, এদের উৎপত্তি হয়েছে হোমো আলপিনাজদের থেকে। রামাপ্রসাদের মতানুযায়ী আলপিনাজদের একটি শাখা
মধ্য ও নিম্নগাঙ্গীয় উপত্যকার দিকে স্থানান্তরিত হয়। আর্যদের আগমনের পূর্বে বাংলায় নিষাদ বা অস্ট্রিকভাষী মানুষেরা বসবাস করত। আলপিনাজ বা আলপাইন সম্প্রদায় থেকে নিষাদ সম্প্রদায়ের উত্থান ঘটে।
আর্যদের আগমনের পূর্বে উত্তরবঙ্গ তথা পুণ্ড্রবর্ধনে কোল, ভিল, মুণ্ডা, কিরাত এবং শবর জাতীয় অনার্যরা বসবাস করত। প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে এদের ক্ষত্রিয় বলা হয়েছে। মনুস্মৃতি অনুসারে ক্ষত্রিয় থেকে উৎপন্ন কিরাত জাতিদের অবনতি ঘটেছিল শুদ্র পর্যায়ে। তারা ব্রাহ্মণদের সংস্পর্শে আসত না। এরা প্রাচ্যে বসবাস করত। গুপ্তসম্রাট সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালে লক্ষ করা যায় যে, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার এই তিনটি জেলাই পার্বত্য কোম দ্বারা অধ্যুষিত ছিল। কোচ, রাজবংশী, ভোটিয়া সকলেই ভোট-ব্রহ্মজনের বিভিন্ন শাখা-উপশাখা। সূক্ষ্ম নৃতাত্ত্বিক বিচারে পরিলক্ষিত হয় যে, উত্তরবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের সীমান্ত রাজ্যগুলিতে অতীতে মঙ্গলজাতির অধিবাসীরা বসবাস করত। মহাভারতের শাস্তিপর্ব এবং সভাপর্বে বঙ্গ, পুণ্ড্র ও কিরাত দেশের উল্লেখ রয়েছে। হিউয়েন সাঙের রচনাবলি এবং দামোদরপুর লিপি থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যাধীন পুণ্ড্রবর্ধনভূত্তির কথা জানা যায়।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর মতানুযায়ী, কাম্বোজরা তিব্বত, ভুটান প্রভৃতি পার্বত্য অঞ্চলের কোনো মঙ্গোলীয়জনের শাখা এবং বর্তমান উত্তরবঙ্গোর কোচ-পালিয়া-রা জবংশীয়দের পূর্বপুরুষ। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে একাধিক মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী বঙ্গে বিস্তারলাভ করে। ঐতেরেয় ব্রাহ্মণ এবং বোধায়ন ধর্মসূত্রে দেখা যায় যে, পুণ্ড্ররা অন্তু, শবর, পুলিন্দ ও মুতিব কোমদের সংলগ্ন এবং আত্মীয়। আবার মহাভারতের আদিপর্বে পুণ্ড্রদের অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সুক্ষ্মদের ঘনিষ্ঠ জ্ঞাতি বলা হয়েছে। প্রাচীন সাখ্য অনুযায়ী সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুণ্ড্র পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে পুণ্ড্রবর্ধনে রূপান্তরিত হয় যা পরবর্তীকালে বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রী নামেও পরিচিত হয়।
আর্যদের একটি শাখা উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের পর্বতশ্রেণি অতিক্রম করে পঞ্চনদে প্রবেশ করে। অথর্ববেদের পঞ্চম কান্ডে বঙ্গ ও মগধদেশে আর্যদের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। ঐতেরেয় ব্রাহ্মণ ও মানব ধর্মশাস্ত্র থেকে পুণ্ড্র জাতির কথা জানা যায়। অতএব এ কথা বলা যায় যে, পুণ্ড্রবর্ধন বা উত্তরবঙ্গ আর্যদের পরিচিত হয়েছিল। আর্য্যোপনিবেশের পূর্বে যে প্রাচীন জাতি ভূমধ্যসাগর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত নিজ অধিকার বিস্তার করেছিল তারাই ঋগবেদে ‘দস্যু’ নামে পরিচিত। এই প্রাচীন দ্রাবিড়োজাতিই বঙ্গ-মগধের আদিম অধিবাসী। নৃতত্ত্ববিদগণেরা নাসিকা ও মস্তক পরীক্ষার দ্বারা তাদেরকে দ্রাবিড় ও মোঙ্গলীয় জাতির সংমিশ্রণে উৎপন্ন বলে মনে করেন। উত্তরাপথের পশ্চিমাংশ আর্যগণ কর্তৃক বিজিত হওয়ার বহুকাল পরেও বঙ্গ ও মগধ স্বাধীন ছিল।
প্রাচীন সাহিত্যে আর্যগণ কর্তৃক মগধ ও বঙ্গ অধিকারের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে আর্যজাতির বঙ্গ ও মগধ অধিকারের প্রকৃত সময় নির্ণয় দুরূহ ব্যাপার। সিংহলের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বা তার পূর্বে মগধে ও বঙ্গে আর্যসভ্যতা প্রসারিত হয়েছিল। বঙ্গের প্রাচীন অধিবাসীরা পুরাতন ভাষা ও রীতিনীতি পরিত্যাগ করে আর্যজাতির আচার-ব্যবহার ও ধর্ম গ্রহণ করে।