1877 সালের সাতসুমা বিদ্রোহ সমালোচনা কর।

1877 সালের সাতসুমা বিদ্রোহ

ভূমিকা: ১৮৭৭ সালের সাতসুমা বিদ্রোহ (Satsuma Rebellion), যা “শিমাদা বিদ্রোহ” নামেও পরিচিত, জাপানের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এটি ছিল জাপানের মেইজি যুগে এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক এবং সামরিক উত্তেজনা, যেখানে সাতসুমা অঞ্চলের সামুরাইরা সরকারী সংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। সাতসুমা বিদ্রোহ ছিল একদিকে জাপানের আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়া, অন্যদিকে প্রথাগত সামুরাই সমাজের পতনের প্রতীক। এই বিদ্রোহ ছিল এক অনিশ্চিত পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া, যা জাপানকে একটি আধুনিক জাতিতে পরিণত করতে চেয়েছিল, তবে প্রথাগত সামুরাই শ্রেণী এটি মানতে চায়নি।

প্রেক্ষাপট:

১৮৬৮ সালে মেইজি রেস্টোরেশন এর মাধ্যমে শোগুনাতের পতন ঘটিয়ে জাপানে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন মেইজি সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিল আধুনিকীকরণ এবং পশ্চিমি শক্তির সাথে প্রতিযোগিতার জন্য একটি শক্তিশালী, আধুনিক দেশ গঠন করা। কিন্তু এই পরিবর্তনগুলি প্রথাগত সামুরাই শ্রেণী ও সমরজাতির জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল। সামুরাইদের যুদ্ধের ভূমিকা কমে যাচ্ছিল, এবং তাদের সামাজিক অবস্থানও ধীরে ধীরে নষ্ট হচ্ছিল।

সাতসুমা অঞ্চলের সামুরাইদের মধ্যে এই পরিবর্তনগুলির বিরুদ্ধে গভীর অসন্তোষ ছিল। তারা নতুন সরকারী সংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, বিশেষত, সামুরাইদের জমির মালিকানা এবং সম্মানবোধের প্রতি আঘাতের কারণে। ১৮৭৭ সালের এই বিদ্রোহ, তবে, কেবল সামুরাই শ্রেণীর অসন্তোষের প্রতিফলন ছিল না, বরং এটি প্রথাগত জাপানি সমাজের একটি শেষ চেষ্টার প্রতীক ছিল, যা আধুনিকীকরণের বিরুদ্ধে ছিল।

1877 সালের সাতসুমা বিদ্রোহের কারণ:

১. সামুরাই শ্রেণীর সামাজিক অবস্থান ক্ষুণ্ণ হওয়া: মেইজি সরকারের সংস্কারের ফলে, সামুরাইদের হাতে থাকা ভূমি এবং অন্যান্য বিশেষাধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। সামুরাইদের বেতন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয় এবং তাদের সামাজিক ভূমিকা কমে যায়। এটি তাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে।

২. সামরিক শক্তির প্রয়োজনীয়তা: সামুরাইদের ভূমিকা হ্রাস পাচ্ছিল এবং নতুন আধুনিক সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল, যা প্রথাগত সামরিক কৌশলকে বাদ দিয়ে আধুনিক অস্ত্র ও প্রযুক্তি ব্যবহার করছিল। সাতসুমা বিদ্রোহীরা এই পরিবর্তনকে একপ্রকার জাতীয় অভিশাপ হিসেবে দেখছিল।

৩. সামুরাই সংস্কৃতির বিলুপ্তি: মেইজি রেস্টোরেশনের পর, নতুন সরকার সামুরাইদের প্রথাগত সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভূমিকা থেকে দূরে সরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল। নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা, আইনের সংস্কার এবং সম্রাটের কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনে তারা অনুভব করছিল যে তাদের ঐতিহ্য এবং সম্মান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

বিদ্রোহের ঘটনাপ্রবাহ:

১৮৭৭ সালে সাতসুমা অঞ্চলের নেতা টাকাচিনো হিরোমিন (Takahashi Hirobumi) নেতৃত্বে বিদ্রোহ শুরু হয়। বিদ্রোহীরা নতুন সরকারের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে, তাদের পুরনো শাসন ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিল। প্রথমে বিদ্রোহীরা বিভিন্ন গ্রামে আক্রমণ করে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে।

প্রথম দিকে তারা কিছু অঞ্চলে সফল হলেও, মেইজি সরকারের আধুনিক সেনাবাহিনী এবং তাদের সমর্থনকারী আধুনিক অস্ত্রের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। মেইজি সরকারের শক্তিশালী সেনাবাহিনী এবং সামরিক প্রযুক্তির সামনে সাতসুমা বিদ্রোহীরা পর্যায়ক্রমে পরাজিত হয়।

বিদ্রোহের শেষ দিকে, স্যামুয়েল কুমাসাও (Saigo Takamori), বিদ্রোহের প্রধান নেতা, তাদের পক্ষে লড়াই করতে থাকেন। তবে, বিদ্রোহের চূড়ান্ত পর্যায়ে, স্যামুয়েল কুমাসাও আহত হন এবং আত্মহত্যা করেন। এর ফলে বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং মেইজি সরকার বিজয়ী হয়।

বিদ্রোহের ফলাফল:

১. আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হওয়া: সাতসুমা বিদ্রোহের পর, মেইজি সরকার আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বিদ্রোহীরা পরাজিত হওয়ায়, তারা প্রথাগত সামুরাই সমাজের পতন এবং আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করতে সক্ষম হয়।

২. সামুরাই শ্রেণীর বিলুপ্তি: সাতসুমা বিদ্রোহের পর, সামুরাই শ্রেণীকে রাজনৈতিকভাবে নির্মূল করা হয়। মেইজি সরকারের আধুনিক সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সামুরাইদের ভূমিকা সম্পূর্ণরূপে নিঃশেষিত হয়।

৩. নতুন সামাজিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা: মেইজি সরকারের এই বিজয় জাপানের জন্য নতুন রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তন আনে। নতুন আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, আইন ব্যবস্থাপনা এবং শিল্পায়ন চালু হয়। এই পরিবর্তনগুলির ফলে জাপান দ্রুত শিল্পায়িত এবং একটি শক্তিশালী সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়।

1877 সালের সাতসুমা সমালোচনা:

সাতসুমা বিদ্রোহের পর, কিছু ঐতিহাসিকেরা এই বিদ্রোহকে শুধুমাত্র এক দল বিদ্রোহী সম্রাটের বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে দেখেন, যারা আধুনিকীকরণ এবং উন্নতির বিপরীতে দাঁড়িয়েছিলেন। অন্যদিকে, অনেকেই মনে করেন যে, এটি ছিল একটি শেষ চেষ্টা, একটি ঐতিহ্যগত সমাজের সংস্কৃতি এবং মর্যাদার প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য।

সামুরাইদের প্রতি মেইজি সরকারের আচরণ ছিল অনেক ক্ষেত্রে নৃশংস এবং অত্যাচারী। বিদ্রোহীদের পরাজয়ের পর, মেইজি সরকার তাদের প্রতি কঠোর দমন-পীড়ন চালায়, এবং প্রথাগত সামুরাই মূল্যবোধের প্রতি সম্মান হারায়।

অন্যদিকে, বিদ্রোহীরা অনেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত নৈতিক এবং দেশপ্রেমিক হিসেবে নিজেদের তুলে ধরে, তবে তাদের বিদ্রোহ, যেটি একটি পাল্টা সংস্কারের অংশ হিসেবে শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে।

উপসংহার:

সাতসুমা বিদ্রোহ ছিল জাপানের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা মেইজি রেস্টোরেশনের পরবর্তী পরিবর্তনের প্রতিফলন হিসেবে কাজ করে। এটি আধুনিকীকরণের পক্ষে শক্তিশালী একটি বার্তা ছিল, তবে এটির মাধ্যমে জাপানের পুরনো সমাজ এবং সংস্কৃতির পতন এবং পরিবর্তন স্পষ্ট হয়। সাতসুমা বিদ্রোহের পরবর্তী ফলাফলগুলি জাপানকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী এবং আধুনিক জাতিতে পরিণত করতে সাহায্য করেছিল, তবে এর সাথে একটি বিশেষ সামাজিক শ্রেণীর বিলুপ্তি এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের শোকও যুক্ত ছিল।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading