1904 খ্রিস্টাব্দে ঘোষিত লর্ড কার্জনের শিক্ষানীতি
1904 খ্রিস্টাব্দের 11 মার্চ লর্ড কার্জন এক সরকারি সিদ্ধান্তের আকারে সরকারের শিক্ষানীতি ঘোষণা করেন। 1901 খ্রিস্টাব্দে সিমলা সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবসমূহকে ভিত্তি করেই এই সরকারি নীতি প্রস্তুত হয়। এই সরকারি সিদ্ধান্তের প্রথমেই সমসাময়িক ভারতের শিক্ষা-চিত্রটি প্রথমে তুলে ধরা হয়। বলা হয়, ভারতের প্রতি পাঁচটি গ্রামের মধ্যে চারটিতেই বিদ্যালয় নেই। প্রতি পাঁচটি বালকের মধ্যে তিনটি বালক এবং চল্লিশটি বালিকার মধ্যে উনচল্লিশটি বালিকাই কোনোরকম শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত।
স্বীকার করা হয়েছে, বিগত কুড়ি বছরে শিক্ষার প্রসার ঘটলেও তা আশানুরূপ নয়। শিক্ষার লক্ষ্য ছিল সংকীর্ণ। একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল কোনো রকমের সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করা। ফলে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াই ছিল শিক্ষার লক্ষ্য। প্রকৃত শিক্ষা ছিল অধরা। পুথিগত শিক্ষার প্রাধান্য ছিল। কারিগরি বা বৃত্তিশিক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না। মুখ্য পদ্ধতি ছিল বিদ্যালয় ও কলেজীয় শিক্ষার একমাত্র পদ্ধতি। ইংরেজি শিক্ষার উপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়ার ফলে মাতৃভাষা ছিল অবহেলিত। শিক্ষা সংক্রান্ত সরকারি নীতিগুলি হল-
• উডের ডেসপ্যাচ (1854) এবং হান্টার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করে বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহিত করা।
• সরকার নিয়ন্ত্রিত কিছু প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারি উদ্যোগের নিকট মডেল হিসেবে তুলে ধরা যাতে তারা শিক্ষার মান বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়। • নিয়মিত পরিদর্শনের মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা।
• পরিদর্শকদের কেবলমাত্র পরীক্ষার ফলের উপর গুরুত্ব না দিয়ে শিক্ষণ পদ্ধতি, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ইত্যাদির উপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়। • সরকারকে শিক্ষা পদ্ধতি ও শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে পরামর্শ দেবার জন্য পরিদর্শকদের নির্দেশ দেওয়া হয়।
বিভিন্ন শিক্ষা স্তরের প্রেক্ষিতে যেসব নীতিগুলি উল্লেখ করা হয় সেগুলি হল-
মাধ্যমিক শিক্ষা:
বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজীয় শিক্ষায় কার্জন যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে একই নীতি ঘোষণা করেন যা 1904 খ্রিস্টাব্দে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি সিদ্ধান্ত বলে ঘোষিত হয়। কার্জন মন্তব্য করেন যে, 1882 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1982 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার দ্রুত প্রসার ঘটে। কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে ও ‘শিক্ষাকেন্দ্র’ থেকে ‘কোচিং কেন্দ্র’ বলাটা সঠিক। বহু মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা হতাশাজনক। মাধ্যমিক শিক্ষাক্ষেত্রে কার্জন যে নতুন নীতি গ্রহণ করেন তার দুটি দিক আছে- (ক) নিয়ন্ত্রণ ও (খ) উন্নয়ন।
(ক) নিয়ন্ত্রণ: সরকার বিভিন্নভাবে বেসরকারি উদ্যোগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন, যেমন-
• বিভাগীয় অনুমোদন: বিভাগীয় অনুমোদন ব্যতীত কোনো নতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা যাবে না। সাহায্যপ্রাপ্ত বা সাহায্যপ্রাপ্ত নয়-সব মাধ্যমিক বিদ্যালয়কেই বিভাগীয় অনুমতি নিতে হবে।
• বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন: শিক্ষার্থীদের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাঠানোর জন্য বিভাগীয় অনুমোদনের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। এ ছাড়া নিয়ম করা হয় যে, অনুমোদনহীন বিদ্যালয় থেকে অনুমোদন প্রাপ্ত বিদ্যালয়ের ছাত্র ভরতি করা যাবে না। অনুমোদন প্রাপ্ত বিদ্যালয় সরকারি অনুমোদন পাবে। সরকার নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষায় ছাত্র প্রেরণ করতে পারবে এবং সরকারি বৃত্তি পাওয়ার যোগ্য হবে |
(খ) উন্নয়ন: মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। যেমন-
• অনুমোদনে সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়গুলিকে প্রচুর পরিমাণে আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করা হয়।
• মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
• পাঠক্রমকে প্রয়োজনীয় ও ব্যাবহারিক করে তোলার জন্য সব রকমের চেষ্টা করা হয়।
• মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। তবে এই স্তরে উন্নত মানের ইংরেজি ভাষাশিক্ষারও ব্যবস্থা করতে হবে।
• বিদ্যালয় পরিদর্শনের ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকারী করে তোলার ব্যবস্থা করা হয়।
• ছাত্র-বেতন, ছাত্রসংখ্যা ও সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করার কথা ব্যক্ত করা হয়।
শিক্ষা সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়:
• ভারতীয় শিল্পকে উন্নত করতে ব্যর্থ হওয়ায় নান্দনিক শিল্পের উন্নতির জন্য সংস্কারের কথা বলা হয়। কার্জনের মতে, এইসব বিদ্যালয়ের বিষয়, পদ্ধতি এবং সংগঠনের সংস্কার একান্ত জরুরি।
• কৃষিবিদ্যার উন্নতির জন্য কলেজগুলিতে যোগ্য অধ্যাপক এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। মিডল এবং হাই স্কুলে কৃষিবিদ্যাকে বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ কার্জনের প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছিল।
• নীতিশিক্ষা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে বলা হয় যে, সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা হবে অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ নীতিশিক্ষা সংক্রান্ত। কার্জন পাঠ্যপুস্তক সুপারিশের বিরোধী ছিলেন। তবে সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ে নীতিশিক্ষার উপর কোনো প্রতিবন্ধকতা তিনি আরোপ করেননি।
• কার্জন উপলব্ধি করেছিলেন ভারতীয় প্রাচীন শিল্পগুলি যথাযথভাবে সংরক্ষিত হয়নি। এর জন্য তিনি একটি পৃথক আর্কিওলজি বিভাগ স্থাপন করেন। 1904 খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন শিল্পগুলি সংরক্ষণের আইন অনুমোদনের পশ্চাতে কার্জনের বিশেষ ভূমিকা ছিল।
• স্ত্রীশিক্ষার প্রসারের জন্য অধিক সংখ্যক আদর্শ বিদ্যালয় স্থাপন এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
• ভারতীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে কার্জনের অন্যতম অবদান হল ভারতবর্ষে ‘Director General of Education’ পদ সৃষ্টি করা।