১৯৩০-এর দশকে দল ও রাষ্ট্রের পরিবর্তনের কারণ:
বিশ্ব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল ১৯৩০-এর দশক, যা বৈশ্বিক রাজনীতির পরিবর্তন, শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন এবং রাষ্ট্রীয় শক্তির উত্থান-পতনের ঘটনা ছিল। এই দশকে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে নতুন রাজনৈতিক ধারণা, সামরিক অভিযান এবং অর্থনৈতিক সংকটগুলির মাধ্যমে রাজ্য এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পরিবর্তন ঘটেছিল। বিশেষভাবে, এই সময় চীনে, ভারত উপমহাদেশে, জার্মানি, ইতালি এবং অন্যান্য দেশে যা ঘটেছিল তা আধুনিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়।
এই প্রবন্ধে, আমরা বিশ্লেষণ করব কেন ১৯৩০-এর দশক রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রের কাঠামোয় এবং কার্যক্রমে বিশাল পরিবর্তন এনে দেয়।
১. বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা:
১৯২৯ সালে শুরু হওয়া বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা বা গ্রেট ডিপ্রেশন ছিল ১৯৩০-এর দশকে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ। এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে বেশ কয়েকটি দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, কৃষি সংকট এবং শিল্পের পতন দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে বিপজ্জনক করে তুলেছিল। বিশেষ করে, ইউরোপ এবং আমেরিকায় এর প্রভাব ছিল ব্যাপক। এই সংকটটি একদিকে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়ে দিয়েছিল, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোকে নানা ধরনের সমাধান দিতে বাধ্য করেছিল।
উদাহরণস্বরূপ, ন্যূনতম সরকার এবং মুক্তবাজার দর্শনে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলি তখনকার পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়। ফলে জনগণের মধ্যে বিপুল অস্থিরতা তৈরি হয়, যা একদিকে নতুন রাজনৈতিক দল এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি সমর্থন বৃদ্ধির সুযোগ করে দেয়।
২. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি:
১৯৩০-এর দশকে জাতিসংঘ এবং বিশ্বের বৃহত্তম শক্তিগুলির মধ্যে যুদ্ধের প্রস্তুতি ছিল অপরিহার্য। বিশ্বযুদ্ধের অঙ্গীকার এবং হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি জার্মানি এবং মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট ইতালি রাষ্ট্রের ভূমিকায় পরিবর্তন আনতে থাকে। তাঁদের আগ্রাসনমূলক নীতি এবং মিত্রপক্ষের সাথে সম্পর্কের কারণে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে।
এছাড়া, এই সময়ে সামাজিক নীতি এবং রাষ্ট্রীয় আদর্শিক পরিবর্তন যেমন, জার্মানিতে নাৎসি দল এবং ইতালিতে ফ্যাসিস্টদের উত্থান এবং গণতন্ত্রের প্রতি তাদের শত্রুতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৩. রাজনৈতিক দলগুলির অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন:
১৯৩০-এর দশকটি রাজনৈতিক দলের জন্য একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের সময় ছিল। উদাহরণস্বরূপ, সোভিয়েত ইউনিয়নে, সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টি একদিকে স্ট্যালিনিজম প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল, অন্যদিকে, ১৯৩০-এর দশকে সোভিয়েত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে বিপুল পরিমাণ সংস্কার এবং জবরদস্তি চালানো হয়। স্ট্যালিনের শাসনে গণহত্যা এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়ন চালানো হয়, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির উত্থানেও ভূমিকা রাখে।
অন্যদিকে, জাতীয়তাবাদ এবং ফ্যাসিবাদ উঠে আসে। ইউরোপে ফ্যাসিস্ট পার্টির উত্থান, বিশেষত জার্মানি এবং ইতালিতে, ১৯৩০-এর দশকে রাজনৈতিক দলে পরিবর্তনের প্রবণতা তৈরি করে। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র গঠন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের শক্তি বৃদ্ধি নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যা রাষ্ট্রের একনায়কতান্ত্রিক শাসনকে প্রতিষ্ঠিত করে।
৪. আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং উপনিবেশবাদের পতন:
১৯৩০-এর দশকে, বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে, বেশ কিছু দেশের উপনিবেশিত জনগণ স্বাধীনতার জন্য লড়াই শুরু করে। এসময়, ভারত, চীন, আফ্রিকা, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ আন্দোলন পরিচালনা করছিল। ভারতের গাঁধীজির নেতৃত্বে এবং চীনে কমিউনিস্ট পার্টির সংগ্রামের মধ্যে, এশিয়ার দেশগুলি নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং দলগুলির উত্থান দেখছিল।
এছাড়া, নব্যউপনিবেশবাদ এবং আধুনিক স্বাধীন রাষ্ট্রের ধারণাও এই দশকে অনেক শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আধুনিক জাতীয়তাবাদী দলগুলো, যেমন ভারতীয় কংগ্রেস, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি, আফ্রিকান মুক্তি সংগ্রামী দলগুলো তাদের ক্ষমতার রাজনীতির দিকে নজর দেয়।
৫. বিশ্বের মধ্যে আদর্শগত দ্বন্দ্ব:
১৯৩০-এর দশকে, রাজনৈতিক আদর্শগুলির মধ্যে দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা পায়। একদিকে, মার্কসবাদী-কমিউনিস্ট দলগুলি ছিল, যারা শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতায়ন এবং সম্পদ বণ্টনে বিশ্বাসী ছিল; অন্যদিকে, ফ্যাসিস্ট এবং জাতীয়তাবাদী দলগুলি তাদের সমাজের ওপর একনায়কতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। এসব আদর্শগত দ্বন্দ্ব শুধু রাজনৈতিক দলের পরিবর্তনই আনেনি, বরং রাষ্ট্রের মধ্যে গণতান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক এবং উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির উপরেও প্রভাব ফেলেছিল।
৬. সংস্কৃতি ও শিক্ষার পরিবর্তন:
১৯৩০-এর দশকে, রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির পরিবর্তন এবং শিক্ষা ব্যবস্থা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ এবং রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে সম্পর্কের মাধ্যমে জনগণের প্রতি প্রভাব তৈরি হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্যাসিস্ট ইতালি এবং নাৎসি জার্মানির রাষ্ট্রীয় পরিচালনায় সংস্কৃতি এবং শিক্ষার মধ্যে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়। এটি রাজনীতির পরিবর্তন এবং দলগুলির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক উপায় হয়ে ওঠে।
উপসংহার:
১৯৩০-এর দশকে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলের পরিবর্তনের পিছনে একাধিক কারণ ছিল, যার মধ্যে অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক আদর্শের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির চাপ ছিল প্রধান। এই দশকটি ছিল বিশ্বের ইতিহাসে শাসনব্যবস্থা, দলগুলোর আদর্শ এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর উত্থান ও পতনের এক যুগান্তকারী সময়। ১৯৩০-এর দশক একটি নতুন রাজনৈতিক যুগের সূচনা করে, যা পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধ এবং আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যায়।