আঞ্চলিকতাবাদ বলতে কী বােঝায় ? ভারতে আঞ্চলিকতাবাদের বিভিন্ন কারণগুলি ব্যাখ্যা কর(What does regionalism mean? Explain the various causes of regionalism in India)

উত্তর:- আঞ্চলিকতাবাদের অর্থ সম্পর্কে বিভিন্ন চিন্তাবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। সাধারনভাবে আঞ্চলিকতার ধারনা এবং ভারতীয় পরিস্থিতিতে আঞ্চলিকতার ধারনা এক নয়। তেমনি আবার আঞ্চলিকতাবাদ সম্পর্কিত পাশ্চাত্ত্য ও প্রাচ্য ধারনার মধ্যেও পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। টমাস ও হুয়েজলিন আঞ্চলিকতাবাদের পশ্চিমী ধারণা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এই রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীদ্বয়ের মতানুসারে উপজাতি বা জাতির অংশবিশেষ (subnational) এবং অতিজাতি (transnational)-র মধ্যে পার্থক্যের অস্তিত্ব এবং স্বাতন্ত্র ও প্রতিশ্রুতির পার্থক্য আঞ্চলিকতা হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। আবার আর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্রের উপর গুরুত্ব আরােপের জন্যও আঞ্চলিকতাবাদের ধারণা ব্যবহার করা হয়। আবার অনেকের অভিমত অনুসারে মাত্রাতিরিক্ত ও পীড়নমূলক এককেন্দ্রিকতার বিরােধী আন্দোলন আঞ্চলিকতাবাদ হিসাবে বিবেচিত হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে আঞ্চলিকতাবাদ হল একটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতির ভৌগােলিক এলাকার প্রতি তাৎপর্যপূর্ণ একব্রনের বিশেষ আনুগত্য। জাতীয় ভূখণ্ডের সঙ্গে অধিবাসীদের একধরনের সংযােগ-সম্পর্ক বা টান থাকে। এর থেকে স্বতন্ত্র আর একধরনের সংযােগ-সম্পর্ক বা আনুগত্য পরিলক্ষিত হয়। জাতীয় ভূখণ্ডের প্রশাসনিক বিভাজন বা প্রাদেশিকতার পরিপ্রেক্ষিতে এই আনুগত্য বা সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। এ রকম সংযােগ-সম্পর্ক বা আনুগত্য আঞ্চলিকতা হিসাবে প্রতীয়মান হয়।

ভারতে আঞ্চলিকতাবাদের বিভিন্ন কারণ (Causes of Origin of Regionalism in India)

স্বাধীনতালাভের উত্তর পর্বে ভারতে আঞ্চলিকতাবাদের বিকাশ ও বিস্তারের বিষয়টি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা দরকার। এ ক্ষেত্রে বহু ও বিভিন্ন কারণ বর্তমান ।

1. ভৌগােলিক কারণ : দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে খাদ্যাভ্যাস, পােশাক-পরিচ্ছদ, ভাষা এবং জীবনধারার অন্যান্য ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এই সমস্ত পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীরা পরস্পরকে স্বজন ভাবে না, বিদেশী ভাবে। তারফলে বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে স্বদেশবাসীর চেতনা জাগ্রত না হয়ে ভয় এবং ঘৃণার মনােভাবের সৃষ্টি হয়েছে।

2. ঐতিহাসিক কারণ : আর্যদের আমল থেকে ভারতের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ে পার্থক্য বর্তমান। উত্তর ভারতের অনেক নৃপতি দক্ষিণ ভারতে রাজ্যবিস্তার করেছেন। আবার দক্ষিণ ভারতের কিছু সাম্রাজ্য ভারতের উত্তরাংশ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। এই সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতের অধিবাসীদের মধ্যে পারস্পরিক এক স্বাতন্ত্র্যবােধের সৃষ্টি হয়েছে।

3. আঞ্চলিক রাজনীতিক দল ও এলিটদের আবির্ভাব : কংগ্রেসের বিভাজনের পর অনেক আঞ্চলিক রাজনীতিক দল গড়ে উঠেছে এবং আঞ্চলিক স্তরে রাজনীতিক এলিটদের আবির্ভাব ঘটেছে। আঞ্চলিক রাজনীতিক দল ও আঞ্চলিক এলিটদের রাজনীতিক সাফল্যের স্বার্থে পুরােপুরি আলিক সমর্থনের উপর নির্ভর করতে হয়। স্বভাবতই তারা আলিক রাজনীতিক শক্তিগুলিকে উজ্জীবিত করেন এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অধিবাসীদের বিক্ষোভ-বিদ্রোহকে প্রাণবন্ত করে তুলতে আত্মনিয়ােগ করেন। আঞ্চলিক রাজনীতিক দল ও এলিটরা স্বভাবতই দেশ ও জাতির বৃহত্তর বিষয় ও সমস্যাদির পরিবর্তে আঞ্চলিক সমস্যা ও বিষয়াদিকে বড় করে দেখেন এবং বড় করে তুলে ধরেন। তার ফলে আঞ্চলিকতাবাদী শক্তিগুলি ইন্ধনপ্রাপ্ত হয়ে প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে পড়ে।

4. জাতীয় রাজনীতিক এলিটদের দায়িত্ব : ভারতে আঞ্চলিকতাবাদের বিকাশ ও বিস্তারের পিছনে কেন্দ্রের বিশিষ্ট রাজনীতিক নেতা বা এলিটদের ইতিবাচক ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আঞ্চলিক রাজনীতিক শক্তিগুলিকে তােয়াজ করার প্রবণতা জাতীয় নেতাদের মধ্যে প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয়। ভারতে জাতীয় স্তরের রাজনীতিক নেতা বা এলিটদের মধ্যে এই প্রবণতা আঞ্চলিকতাবাদকে উজ্জীবিত করেছে।

5.ভাষা-নীতির ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠন : ভাষা-ভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের ব্যবস্থাও আঞ্চলিকতাবাদের বিকাশ ও বিস্তারের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়। ভাষা-নীতি সামগ্রিকভাবে বা পরােপসি প্রযুক্ত হয়নি। অশােক চন্দের মতানুসারে ভাষা-নীতির ভিত্তিতে পুনর্গঠনের পরও অঙ্গরাজ্যগুলি ভাষাগত বিচারে সমজাতীয় সত্তায় পরিণত হতে পারে নি। এন. সি. রায়ের মতানুসারে ভাষাভিত্তিক রাজ্যগলির মধ্যে রাষ্ট্রীয় সচেতনতা এবং স্বাতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব লাভের বাসনা দেখা দিতে পারে। এর ফলে কেন্দ্রের প্রতি বিরূপ মনােভাবের সৃষ্টি হবে এবং আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদী চেতনার সৃষ্টি হবে।

6. প্রবল কেন্দ্রপ্রবণতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া : স্বাধীনতার পর ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দল। একনাগাড়ে ছাব্বিশ বছর কেন্দ্রে এবং প্রায় সকল অঙ্গরাজ্যে ক্ষমতাসীন ছিল। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকারের কেন্দ্রপ্রবণতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন আঞ্চলিক গােষ্ঠী গড়ে উঠে। এই সমস্ত গােষ্ঠী আঞ্চলিকতাবাদী বিভিন্ন আন্দোলন ও বিক্ষোভকে সমর্থন জানায়। রাজনীতিক স্বার্থসাধনের জন্য কমিউনিস্ট, অ-কমিউনিস্ট নির্বিশেষে অন্যান্য রাজনীতিক দলও এই সমস্ত আঞ্চলিকতাবাদী আন্দোলনকে কখনাে প্রত্যক্ষভাবে আবার কখনাে পরােক্ষভাবে সমর্থন করতে দ্বিধা করেনি। তার ফলে আঞ্চলিকতাবাদী রাজনীতিক শক্তিগুলি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

7. ভারত সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচী : ভারত সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচীও আঞ্চলিকতাবাদী প্রবণতার পক্ষে গেছে। ভারতে বহু ও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মানুষ বসবাস করে। এদেশে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সফলভাবে কার্যকর করার জন্য সকল ধময়ি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের অনুকূল আচার-আচরণ ও মূল্যবােধ গড়ে তােলা দরকার ছিল। এ ব্যাপারে ভারত সরকার তেমন কোনাে উদ্যোগ-আয়ােজন গ্রহণ করেনি। তার ফলে ধর্মীয় আঞ্চলিকতাবাদের পথ প্রশস্ত হয়েছে। আব

ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রকৃতির পরিবর্তন সম্পর্কে একটি নোট লেখ

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading