পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে আসাম-বাংলার সীমানা অঞ্চলে বসবাসকারী কোচজাতির এক গোষ্ঠীপ্রধান হাড়িয়া তথা হরি মণ্ডল চিকনা পর্বতে একটি ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের ভূস্বামী ছিলেন। নৃতাত্ত্বিক বিচারে কোচগণ হলেন দ্রাবিড় ও বোডো জাতির মিশ্রণ সঞ্জাত। শাস্ত্রীয় মতে, পুরাকালের কোনো ক্ষত্রবংশ অবস্থার-বিপাকে পড়ে ‘ভঙ্গক্ষত্রিয়’ রূপে উত্তর বাংলার অরণ্যভূমিতে আত্মগোপন করে। সম্ভবত দ্রাবিড় বংশীয় পুণ্ড্রগণের কোনো একটি শাখা এইভাবে এক সময়ের যুদ্ধ ও রাজ্য পরিচালনার পরিবর্তে কৃষিকর্মে লিপ্ত হয়ে প্রাকৃত জনজীবনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। উত্তর ভারতের প্রায় সমস্ত দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক গোষ্ঠীর মতো স্বভাবতই এঁরাও আর্য-ভাষাভাষী হয়ে যান। পরবর্তীকালে ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকা বেয়ে আগত বিশাল ইন্দোচিনীয় ‘বোভো’ গোষ্ঠীর লোকের সঙ্গে মিশ্রণে যে বিভিন্ন উপশ্রেণীয় কোম সৃষ্টি হয় ‘কোচ’ তাদের মধ্যে একটি। তবে নৃতাত্ত্বিক বিচারে যাই হোক, ভাষাতত্ত্বের বিচারে দেখা যাবে, এরা মূলত আর্য ভাষাগোষ্ঠীর এবং সেই কারণেই আর্যায়িত দ্রাবিড় পুণ্ড্র বংশীয়দের ঐতিহ্যজাত বলে অনুমানের সঙ্গে এই তিথ্য মিলে যাচ্ছে। যাই হোক, লোকায়ত কৌম-জীবন থেকে উঠে-আসা এবং স্বভাবতই উপভাষার বৈশিষ্ট্যসহ বাংলাভাষী কোচগণ-মধ্যযুগীয় প্রান্তিক উত্তরবঙ্গে গৌরবময় রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার দ্বারা ইতিহাস-বিখ্যাত হয়ে রইলেন।
র্বকথিত হাড়িয়া বা হরি মণ্ডলের রাজত্বের কেন্দ্রস্থল চিকনা পর্বত ছিল বর্তমান অসমের ধুবড়ি শহর থেকে 50 মাইল উত্তরে, সংকোশ ও চম্পাবতী নদীর হরি মণ্ডলের ছিল দুই স্ত্রী ও চার পুত্র, হীরাদেবীর গর্ভে বিশ্বসিংহ ও শিষ্যসিংহ এবং জীবাদেবীর গর্ভে মদন ও চন্দন। 1498 খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুলতান হুসেন শাহ কামতাপুররাজ নীলাম্বরকে উচ্ছেদ করে সেখানে নিজ পুত্র দানিয়েলকে শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। আনুমানিক 1508 খ্রিস্টাব্দে দানিয়েল কামরুপের অহমবংশীয় রাজা সুহঙ্গ-মুল্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন, কিন্তু মুসলিম অভিযান মর্মান্তিকভাবে ব্যর্থ হয় এবং এক খণ্ডযুদ্ধে দানিয়েল নিহত হন। দানিয়েলের মৃত্যুতে কামতাপুরের ওপর তুর্কিশাসন পতনোন্মুখ হয়ে পড়ে। এই সুযোগে হরি মণ্ডলের যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী পুত্রগণ স্থানীয় তুর্কি কোতোয়ালকে যুদ্ধে পরাস্ত করে কামতাপুরের এক বড়ো অংশ দখল করে নেয়। এই যুদ্ধে জীবাদেবীর প্রথম পুত্র মদন নিহত হওয়ায়, বয়োজ্যেষ্ঠ হয়েও বিশ্বসিংহ নিজে সিংহাসনে না বসে, মদনের ভাই চন্দনকে বসান (1510) খ্রিস্টাব্দ) এবং তাঁকে ‘মহারাজা’ উপাধি দেওয়া হয়। মহারাজা চন্দনের আমলেই, প্রধানত বিশ্বসিংহের সৈন্যাপত্যে ও যুদ্ধকৌশলে সমগ্র কামতাপুর রাজ্য কোচরাজের অধীনে চলে আসে। এটিই হল কোচরাজবংশের পত্তনের ইতিহাস।
অপুত্রক মহারাজা চন্দনের আকস্মিক মৃত্যুর ফলে বিশ্বসিংহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। অভিষেকের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি রাজ্যবিস্তারে মন দেন এবং একে একে সৌমার রাজ্য, বিজনী বিভাগ্রাম এবং বিজয়পুর দখল করে নেন। উত্তরদিকে ভূটান সরকারের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তিনি সম্পূর্ণ সফল হতে পারেননি, অগত্যা তাঁকে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হতে হয়। কিন্তু এর পরে বিশ্বসিংহ যে দুঃসাহসিক কাজ করে বসলেন, তা হল হুসেন শাহের রাজধানী গৌড় আক্রমণ। রণনীতি ও কূটনীতি বিশেষজ্ঞ-বিশ্বসিংহ এমন সময় গৌড়রাজ্য আক্রমণ করেন, যখন সুলতানি (1512-18 খ্রি.) সৈন্য ও সেনাপতিগণ ত্রিপুরা জয়ে ব্যস্ত। তুর্কি সৈন্যের সঙ্গে নানা স্থানে তাঁর যুদ্ধ হয় এবং দুর্গীলম শক্তিকে ক্রমাগত পরাভূত করেন। তিনি রংপুর-দিনাজপুর পর্যন্ত প্রসারিত এক বিশাল ভূখণ্ড সুলতানি শাসন থেকে কোচবিহারের শাসনাধীনে নিয়ে আসেন?
এই বিশাল রাজ্যশাসনের সুবিধার জন্য বিশ্বসিংহ রাজধানী চিকনা পর্বত থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে সমতল ভূমিতে নেমে আসেন এবং বর্তমান আলিপুরদুয়ারের পূর্বদিকে হিঙ্গুলাবাদ নামক স্থানে রাজধানী নির্মাণ করেন। এই হিঙ্গুলাবাদের বর্তমান নাম মহাকালগুড়ি, সেখানে ‘হিঙ্গুলাকোট’ এখনও বর্তমান। যাইহোক, নতুন রাজধানীতে ক্ষমতা সংহত করার আগেই 1532 খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের সুলতান নসরত শাহ বিশ্বসিংহের রাজ্য আক্রমণ করেন, কিন্তু তাঁর এই সামরিক অভিযান সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়