ধনের নিষ্কাশন:
“ধনের নিষ্কাশন” (Drain of Wealth) শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন দাদাভাই নওরোজি, যিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ভারতের অর্থনৈতিক শোষণ সম্পর্কে প্রথম বিস্তার� ধনের নিষ্কাশনের ধারণা বোঝায় যে, ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ভারতের উৎপাদিত সম্পদ ভারতের অভ্যন্তরে না থেকে ব্রিটেনেস্থানান্তরিতেতে ব্যাপক আর্থিক ও সামাজিক প্রভাব ফেলেছিল। বাংলার ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া আরও তীব্র ছিল, কারণ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাকে তাদের শাসনের মূল অর্থনৈতিক ভিত্তি হিসেবে ব্যবকরে�ছিল।
ধনের নিষ্কাশন: সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য
“ধনের নিষ্কাশন” বলতে বোঝায় এমন একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া, যেখানে ভারতের সম্পদ ও শ্রমের ফলাফল ব্রিটেনে স্থানান্তরিত হয়, বিনিময়ে ভারতবা হয় না।
ধনের নিষ্কাশন প্রক্রিয়ার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হলো:
- রাজস্বের স্থানান্তর: ভারত থেকে সংগৃহীত করের একটি বড় অংশ ব্রিটেনে স্থানান্তরিত হতো।
- বাণিজ্যিক ভারসাম্যের অভাব: ভারতীয় কাঁচামাল এবং উৎপাদিত পণ্য ব্রিটেনে রপ্তানি করা হতো, কিন্তু এর বিপরীতে ভারতে ব্রিটিশ পণ্যমুনাফ�ন করা হতো।
- উপনিবেশিক প্রশাসনের ব্যয়ভার: ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার ব্যয়ভার ভারতীয়দের কর থেকে বহন করা হতো।
- সামরিক খরচ: ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশে পরিচালিত সামরিক অভিযানের ব্যয়ভার ভারতীয় রাজস্ব থেকে বহন করা হতো।
- সুদ ও লভ্যাংশ: ব্রিটেনে অবস্থিত ব্রিটিশ কোম্পানি এবং ব্যক্তিদের বিনিয়োগ থেকে অর্জিত লভ্যাংশ ভারত থেকে ব্রিটেনে পাঠানো হতো।
বাংলার অর্থনীতিতে ধনের নিষ্কাশনের প্রভাব
১. বাংলার কৃষি ব্যবস্থার ক্ষতি
- অতিরিক্ত করের বোঝা: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি পাওয়ার পর রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থায় কে ভঙ্গ করে।
- নগদ ফসল উৎপাদন: স্থানীয় কৃষকদের থেকে বাধ্যতামূলক নগদ ফসল উৎপাদন করিয়ে নেওয়া হতো, যেমন নীল, যা স্থানীয় চাহিদার তুলনায় ব্রিপূরবহৃত হতো।
২. বাংলার শিল্পের পতন
- তাঁতশিল্পের ধ্বংস: বাংলার তাঁতশিল্প, যা একসময় পৃথিবীজুড়ে বিখ্যাত ছিল, ব্রিটিশ শাসনের কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ব্রিটেন থেকে আবয় টিকতে পারেনি।
- অধিক কর: কারিগরদের উপর অতিরিক্ত কর আরোপের ফলে তারা নিজেদের পেশা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়।
৩. ব্যবসায়িক কাঠামোর পরিবর্তন
- ব্রিটিশরা বাংলার বাজারকে তাদের একচেটিয়া বাণিজ্যের জন্য•স্থানীয়করত।
- স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ব্রিটিশদের প্রতিযোগিতায় পেরে উঠতে না পেরে দারিদ্র্যের শিকার হন।
৪. বাণিজ্যিক ভারসাম্যের অভাব
- ব্রিটিশ নীতির ফলে বাংলার বাণিজ্যে একতরফা শোষণ ঘটে।
- কাঁচামাল রপ্তানি এবং প্রস্তুত পণ্য আমদানির মাধ্যমে বাংলা অর্থনীতির ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়।
৫. দুর্ভিক্ষ ও সামাজিক সংকট
- ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ: অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়, কৃষকদের উপর চাষের চাপ, এবং খাদ্যশস্যের চাষে অবহেলার কারণে বাংলায় দুর্ভিক্ষএ� জনসংখ্যাকে ধ্বংস করে।
- ধনের নিষ্কাশনের ফলে অর্থনৈতিক স্থিতি ভেঙে পড়ে, যা বাংলার কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের জীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।
৬. বাংলার আর্থিক ব্যবস্থার উপর প্রভাব
- পুঁজি সঞ্চয়ের অভাব: ধনের নিষ্কাশনের ফলে বাংলায় শিল্প ও অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য পুঁজি সঞ্চয় সম্ভব হয়নি।
- ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতা: ব্রিটিশ শাসন বাংলার আর্থিক ব্যবস্থাকে শোষণমুখী করে তোলে, যা একটি স্বনির্ভর অর্থনীতি গ�তোলার পথে বাধা সৃষ্টি করে।
ধনের নিষ্কাশন: বাংলার অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
১. দারিদ্র্যের বিস্তার
ধনের নিষ্কাশনের ফলে বাংলার জনগণ ক্রমশ দারিদ্র্যের শিকার হয়। রাজস্বের অধিকাংশ ব্রিটেনে স্থানান্তরিত হওয়ায়সম সম্পদের অভাবে ভুগতে থাকে।
২. শিল্পায়নে প্রতিবন্ধকতা
ব্রিটিশদের কৌশলগত পরিকল্পনার কারণে বাংলা কোনও শিল্পবিপ্লবের সাক্ষী হয়নি। এটি বাংলার তিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে।
৩. সামাজিক অস্থিরতা
- কৃষকদের ঋণগ্রস্ত হওয়া এবং জমি হারানোর ফলে বাংলায় ব্যাপক সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয়।
- কাজের অভাবে এবং অভিবাসনের চাপে সমাজের কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে।
৪. জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থান
ধনের নিষ্কাশন এবং তার ফলাফল নিয়ে ভারতীয় নেতাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ে। দাদাভাই নওরোজি এবং আরও অনেক জাতীয়তাজনণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ফলস্বরূপ।
উপসংহার
ধনের নিষ্কাশন বাংলার অর্থনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এটি কৃষি, শিল্প, এবং ব্যবসার উপর ধ্বংসাত্মক প্রভা�দী আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।