ন্যায়বিচারের ধারণাটি কি? ন্যায়বিচার সম্পর্কে বার্কারের দৃষ্টিভঙ্গিটি আলোচনা কর। What is justice? Discuss Barker’s views on justice.

ন্যায়বিচারের ধারণা:

ন্যায়বিচার একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক ও আইনগত ধারণা, যা সঠিক এবং ন্যায্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বোঝায়। এটি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে তাদের অধিকার ও দায়িত্ব অনুযায়ী সম্মান প্রদানের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। ন্যায়বিচার এমন একটি প্রক্রিয়া যা সামাজিক, আইনগত, এবং নৈতিক স্তরে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সঠিকভাবে বিচার করার উদ্দেশ্যে কাজ করে। এটি সমাজে শৃঙ্খলা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তিকে সমান অধিকার এবং সুযোগ দেওয়া হয়।

ন্যায়বিচারের মূল লক্ষ্য হলো:

1.            সামাজিক সমতা: প্রত্যেকের জন্য সমান অধিকার এবং সুযোগ নিশ্চিত করা।

2.            ন্যায্য বিচার: আইনের সামনে সকলকে সমানভাবে দাঁড় করানো এবং বিচারকেও তার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থাকা।

3.            ক্ষমতার ভারসাম্য: শোষণ এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা, এবং ন্যায়বিচারের মাধ্যমে শোষিতদের অধিকার রক্ষা করা।

4.            সত্য প্রতিষ্ঠা: বিচার প্রক্রিয়ায় সঠিক তথ্য, প্রমাণ এবং সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।

ন্যায়বিচার সম্পর্কে বার্কারের দৃষ্টিভঙ্গি

বার্কার (Barker) একজন ব্রিটিশ রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ও সমাজবিজ্ঞানী ছিলেন, যিনি রাষ্ট্র, সমাজ এবং নৈতিকতার সম্পর্ক নিয়ে ব্যাপকভাবে চিন্তা করেছেন। তিনি ন্যায়বিচারের ধারণাকে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কাঠামোর মধ্যে একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন।

বার্কারের ন্যায়বিচারের সংজ্ঞায় কিছু মূল দিক উল্লেখযোগ্য:

1.            ন্যায়বিচারের সামাজিক ভিত্তি: বার্কার মনে করেন, ন্যায়বিচার শুধুমাত্র আইন বা রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি সামাজিক ধারণা, যা মানুষের সম্পর্ক, সমাজের কাঠামো, এবং নৈতিক মূল্যবোধের উপর নির্ভর করে। তিনি বলেছেন, ন্যায়বিচার একটি সমাজের সকল সদস্যের জন্য সমান সুযোগ ও অধিকার নিশ্চিত করতে বাধ্য। এটি মূলত মানুষের মধ্যে সহযোগিতা এবং সম্পর্কের ভিত্তিতে বিকশিত হয়।

2.            ন্যায়বিচারের বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি: বার্কার ন্যায়বিচারকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ধারণা হিসেবে দেখেন, যেখানে বৈষম্য, শ্রেণী ও সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তিতে বিচার করা হয়। তাঁর মতে, সমাজে প্রতিটি গোষ্ঠী বা শ্রেণী তার অবস্থান এবং প্রেক্ষাপটে বিচার পাওয়ার অধিকারী। তিনি একে ‘গুণগত ন্যায়বিচার’ (qualitative justice) হিসেবে চিহ্নিত করেন, যা প্রমাণ করে যে সমাজে সকল মানুষের অধিকার একে অপরের থেকে আলাদা, তাদের পরিস্থিতি অনুযায়ী বিচার করা উচিত।

3.            আধুনিক সমাজে ন্যায়বিচারের সংকট: বার্কার আধুনিক সমাজে ন্যায়বিচারের প্রশ্নে কিছু মৌলিক সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন যে আধুনিক সমাজে ন্যায়বিচারের বাস্তবায়ন অনেক সময় অপ্রতুল থাকে, কারণ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামো অনেক সময় ঐতিহ্যগত গোষ্ঠী বা শ্রেণীগত শক্তির দ্বারা প্রভাবিত থাকে। এর ফলে কিছু শ্রেণী বা গোষ্ঠী তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, অথবা সামাজিক ক্ষমতার কারণে অন্যদের থেকে বেশি সুবিধা পায়, যার ফলে ন্যায়বিচারের নীতির বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

4.            ন্যায়বিচারের কার্যকরী বাস্তবায়ন: বার্কার দাবি করেন যে ন্যায়বিচার কার্যকরীভাবে বাস্তবায়িত হওয়ার জন্য রাষ্ট্র এবং সমাজের মধ্যে একযোগিতার প্রয়োজন। শুধু আইনের মাধ্যমে একে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, বরং সামাজিক সংস্কৃতি এবং জনগণের মানসিকতা পরিবর্তনও প্রয়োজন। তিনি মনে করেন যে, ন্যায়বিচারের মূল ভিত্তি হলো মানুষের মধ্যে নৈতিক এবং সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন, যা সমাজের মধ্যে সমতা এবং মানবাধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করবে।

5.            গণতান্ত্রিক সমাজে ন্যায়বিচারের গুরুত্ব: বার্কার গণতান্ত্রিক সমাজে ন্যায়বিচারের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। গণতান্ত্রিক সমাজে ন্যায়বিচারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের সমান অধিকার নিশ্চিত করা এবং শক্তি ও ক্ষমতার বিভাজন রক্ষা করা। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের মূল কাজ হলো সকল নাগরিককে তাদের অধিকার এবং সুবিধা সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া, যাতে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অন্যদের থেকে অত্যধিক সুবিধা না পায়।

6.            নৈতিক এবং রাজনৈতিক ন্যায়বিচার: বার্কার রাজনৈতিক এবং নৈতিক ন্যায়বিচারের মধ্যে পার্থক্য করেন। তাঁর মতে, নৈতিক ন্যায়বিচার হলো সমাজের সকল সদস্যের জন্য মৌলিক অধিকার এবং নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, যেখানে রাজনৈতিক ন্যায়বিচার হলো রাষ্ট্রের আইন এবং ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা। তাঁর মতে, রাজনৈতিক ন্যায়বিচারের মাধ্যমে মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা সম্ভব, তবে এটি কখনোই সমাজের নৈতিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে ন্যায্য হতে পারে না।

বার্কারের ন্যায়বিচারের তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা

বার্কার যেহেতু ন্যায়বিচারকে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করেছেন, সেহেতু তাঁর তত্ত্বে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আধুনিক সমাজে আইনের শাসন এবং রাজনৈতিক কাঠামো অনেক সময় ন্যায়বিচারের প্রকৃত ধারণাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। সমাজে যেখানে শ্রেণীগত বৈষম্য বা অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিদ্যমান, সেখানে বার্কারের ন্যায়বিচার একমাত্র আইন ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মাধ্যমে পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে না। তাই তার তত্ত্বে বাস্তবিক সমাধান সঠিকভাবে প্রস্তাবিত হয়নি।

উপসংহার

বার্কারের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, ন্যায়বিচার একটি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং নৈতিক কাঠামোর মধ্যে বাস্তবায়িত হতে পারে। এটি কেবল আইন বা রাষ্ট্রের প্রভাবাধীন নয়, বরং সমাজের মানবিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির উপরও নির্ভর করে। বার্কার মনে করেন, সঠিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে হবে, যেখানে সকল মানুষের মৌলিক অধিকার ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হবে।

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading