বড়ু চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যকে আখ্যানকাব্য বলার কারণ  ব্যাখ্যা কর অথবা শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের আবিষ্কার কাহিনি, প্রকাশ, বিষয়বস্তু ও রচনার বিশিষ্টতার পরিচয় |অথবা  বড়ু চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ কাব্যের আনুমানিক রচনা কাল, রচনা বৈশিষ্ট্য এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব

বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কার একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনা। তার সামান্যপূর্বে চর্যাচর্য বিনিশ্চয় প্রকাশিত হলে পাঠক সমাজে বিশেষত যাঁরা পুরাতন সাহিত্যে আকৃষ্ট ঠিক অনুরূপ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল এবং সে আলোড়ন মেলাতে না মেলাতেই আর একখানি পুরাতন পুঁথি প্রকাশিত হয়ে আবার বাদ প্রতিবাদ বিতর্ক সমালোচনার ঝড় তুলল। সেটি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য। রচনাকার–বড়ু চন্ডীদাস। এটি রাধা কৃষ্ণলীলা বিষয়ক পুরাতন ধরনের আখ্যান কাব্য। কিন্তু এ কোন রাধাকৃষ্ণ? এই অমার্জিত রুচির কাব্য পাঠ করে ভক্তেরা নিরতিশয় হতাশ হলেন। ভাষা তাত্ত্বিকেরা কিন্তু উল্লসিত হলেন। এত দিনে মধ্যযুগের বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন মিলল। বাস্তববাদী সমালোচকেরা রাধাকৃষ্ণের উদ্দাম কাম ক্রীড়ার মধ্যে বাঙালি সমাজের যথার্থ পরিচয় পেয়ে বললেন, এইটি যথার্থ মাটির কাছাকাছি কাব্য।

বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনকাব্যের আবিষ্কার :

পণ্ডিত বসত্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ মহাশয় ১৩১৬ বঙ্গাব্দে (ইং-১৯০৯) বলবিষ্ণুপুরের কাছে কাঁকিল্য গ্রাম নিবাসী প্রভুপাদ শ্রীনিবাস আচার্যের দৌহিত্র দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গোয়াল ঘর থেকে বাসলি সেবক বড়ু চন্ডীদাস রচিত রাধাকৃষ্ণ লীলা বিষয়ক এক বৃহৎ কাব্য-পুঁথি আবিষ্কার করেন। ১৩২২ বঙ্গাব্দের পরিষৎ পত্রিকায় বসন্তরঞ্জন ও লিপিতত্ত্ব বিশারদ প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় দু’জনে মিলিত হয়ে প্রাপ্ত পুঁথিটির লিপি বিচার করে এটিকে অতিশয় পুরাতন বাংলা আখ্যান কাব্য বলে নির্ধারিত করলেন। এর কয়েক মাস পরেই ১৩২৩ বঙ্গাব্দে (ইং-১৯১৬) বসন্ত রঞ্জনের সুযোগ্য সম্পাদনায় এই বৃহৎ পুঁথিটি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামে প্রকাশিত হল।

বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনকাব্যের নামকরণ:

শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের একখানি খণ্ডিত পুঁথি ছাড়া এ কাব্যের আর কোনও পুঁথি পাওয়া যায় না। পুঁথিটি প্রাচীন বাংলার তুলোট কাগজে লেখা। এর প্রারম্ভ ও সমাপ্তির দিকের কয়েক খানি পৃষ্ঠা নষ্ট হয়ে গেছে। এই অবস্থায় কবির ভণিতা ভিন্ন তাঁর সম্পর্কে আর কোনও পরিচয় পাওয়া যায় না। পুঁথির আখ্যাপত্র নষ্ট হওয়ার ফলে কাব্যটির নাম, রচনাকাল, পুঁথি নকলের সন তারিখ কিছুই জানা যায়নি। সম্পাদক বসন্তরঞ্জন ভূমিকায় বলেছেন—“দীর্ঘকাল চন্ডীদাস বিরচিত শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের অস্তিত্ব মাত্র শুনিয়া আসিতেছিলাম। এতদিনে তাহার সমাধান হইয়া গেল। আমাদের ধারণা আলোচ্য পুঁথিই শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, এবং সেই হেতু উহার অনুরূপ নাম নির্দেশ করা হইল।” আমরা কিন্তু চন্ডীদাস রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামে কোনও আখ্যান কাব্যের নাম শুনিনি। তবুও সম্পাদক কৃত এই নামকরণ এ পর্যন্ত প্রায় সকলেই স্বীকার করে নিয়েছেন।

বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনকাব্যের রচনাকাল :

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রচনাকাল সম্বন্ধে বিশিষ্ট সাহিত্য গবেষক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. নলিনীকান্ত ভট্টাশালী, ড. সুকুমার সেন, যোগেশ চন্দ্র বিদ্যানিধি বিভিন্ন মতামত পোষণ করলেও এযাবৎ যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় তা হল—পুঁথিটি যে আকারে পাওয়া গেছে তাতে মনে হচ্ছে ১৬শ শতাব্দীর দিকেই পুঁথিটি নকল করা হয়েছিল। পুঁথিটিতে দু’তিন রকম হাতের লেখার সংমিশ্রণ থাকলেও প্রধান হস্তাক্ষর শ’চারেক বছরের পূর্ববর্তী তা নানা পুঁথির সঙ্গে এর লেখা মিলিয়ে ধারণা করা যেতে পারে। উপরভু চৈতন্যদেবের ভক্ত অনুচর সনাতন গোস্বামীর ভাগবতের টীকায়—“শ্রীচন্ডীদাসা নির্দেশিত দানখণ্ড নৌকাখণ্ডাদির” উল্লেখ আছে। তা ছাড়া চৈতন্য প্রভাবিত পরবর্তী রাধাকৃষ্ণ লীলার ধারা থেকে এ কাব্য সম্পূর্ণ পৃথক, সুতরাং একাব্যকে নিঃসন্দেহে পঞ্চদশ শতাব্দির গোড়ার দিকে চৈতন্যাবির্ভাবের পূর্বে ধরা যেতে পারে। কাব্যটির ভাষা, হাতের লেখা, ভাবাদর্শ প্রভৃতি তার প্রমাণ।

বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনকাব্যের ভাষা :

শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের ভাষা নিয়ে বহু তর্কবিতর্ক হয়েছে। চর্যাগানের মতো এর ভাষাও অতি পুরাতন। তবে চর্যার মতো অতটা দুয়ে নয়। এখনও রাঢ় ও রাঢ়ের প্রান্তীয় অঞ্চলের সাধারণ লোকভাষায় এধরনের কিছু শব্দ পাওয়া যায়। যাই হোক, বসন্ত রঞ্জন রায় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ‘ভাষা’ শীর্ষক পরিচ্ছদে ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ এর ভাষা সম্পর্কে প্রাকৃত-অপভ্রংশ কাব্য, ব্যাকরণ ও নাটকের শব্দ ও ব্যাকরণের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা করে তিনি দেখিয়েছেন যে, কীভাবে মূল তৎসম শব্দ ধীরে ধীরে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে এসে প্রায়শই তদ্ভব এবং অর্ধতৎসমে পরিণত হয়েছে।

বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনকাব্যের পরিচয় :

রাধা কৃষ্ণের প্রণয়লীলার সূচনা ও পরিণতি এ কাব্য থেকে মোটামুটি অনুসরণ করা যায়। কৃষ্ণের জন্ম থেকে শুরু করে মথুরা যাত্রা, মথুরা থেকে ক্ষণিকের জন্য বৃন্দাবনে প্রত্যাবর্তন এবং রাধা কৃষ্ণের পুনর্মিলনের পর কংস নিধনের জন্য কৃষ্ণের মথুরা যাত্রা ও রাধার বিলাপ এখানেই পুঁথিটি খণ্ডিত হয়েছে। রাধাকৃষ্ণের পুনর্মিলনে এ কাব্য সমাপ্ত হয়েছিল অথবা রাধার বিলাপেই এটিতে পূর্ণচ্ছেদ পড়েছিল তা বোঝা যাচ্ছে না। যাই হোক শ্রীকৃষ্ণকীর্তন মোট ১৩টি খণ্ডে বিভক্ত—জন্মখণ্ড, তাম্বুলখণ্ড, দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ভারখণ্ড, ছত্রখণ্ড, বৃন্দাবনখণ্ড, কালীয়দমন খণ্ড, যমুনাখণ্ড, হারখণ্ড, বাণখণ্ড, বংশীখণ্ড ও রাধাবিরহ। শেষ অধ্যায় বা রাধাবিরহে ‘খণ্ড’ নামযুক্ত হয়নি। এই জন্য কেউ কেউ মনে করেন, এই শেষাংশ বোধহয় বড়ু চণ্ডীদাসের রচনা নয়, তাঁর রচনা হলে খণ্ড নাম যুক্ত থাকত। উপরন্তু রাধাবিরহ অংশের বর্ণনা ও রচনারীতি এবং রসের ধারাও ও একটু নতুন ধরনের। তাই বলা যায়, কাব্যটি পুনর্মিলনে সমাপ্ত হয়েছিল, না, রাধার বিলাপেই সমাপ্ত হয়েছিল তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading