বাংলা ছড়ার গঠন ও বিষয় বৈচিত্র্য:
ছড়ার কায়া নির্মাণের ক্ষেত্রে ছড়ায় অন্ত্যমিলের ব্যাপারটি গুরুত্ব পায়। এ মিল একটি ‘Objective’ রূপ নির্মিতির দিক নির্দেশ করে। এই রূপ নির্মিতি ছড়ার স্টাইল। এই মিলবিন্যাস নিছক খেয়াল খুশিতে ভরা নয়। শব্দে শব্দে মিল রচনা করতে করতে ছড়ার কায়া বাড়তে থাকে। কিন্তু সেই বৃদ্ধিকরণ নিতান্ত নিরুদ্দেশ যাত্রা নয়, শেষের একটি লক্ষ্য আছে। সব ছড়ারই শেষটুকুই বিশেষত্ব। ছড়ার শেষাংশই হল ছড়ার ‘Climax’, সমাপ্তির সুসম্পূর্ণতা, কোন বিশেষ চরিত্রের, দৃশ্যের, ঘটনার, পরিস্থিতির পরিপূর্ণতা, কোনো ধন্যাত্মক শব্দের বা শব্দদ্বৈতর বিশিষ্ট প্রয়োগ, অনুরোধ-অনুজ্ঞা- প্রতিজ্ঞাসূচক কোন মনোভাব প্রভৃতি যতক্ষণ না এসে পৌঁছায়, তাকেই লক্ষ্য করে ছড়া বাড়তে বাএগোতে থাকে। ছড়ার কায়া নির্মাণে এই শেষাংশের একটি অসামান্য ভূমিকা আছে। ছড়া এমনভাবে বাড়ে যে, একটি রসময় পরিণতি তার থাকেই, সে পরিণতি না এসে পড়া পর্যন্ত ছড়া বাড়তে থাকে। যেমন করেই হোক মিল বা সাম্য সৃষ্টি করায় বাংলা ছড়ার বৈশিষ্ট্য। এর মাধ্যমেই ছড়ার মূল নিহিত থাকে, যা লোকমনস্তত্ত্বের অর্থাৎ মানব জীবনের বিভিন্ন দিককে প্রস্ফুটিত করে। কোন একটি দৃশ্য, ঘটনা, চরিত্র ও পরিস্থিতির বর্ণনা প্রদানের প্রবণতাও ছড়ার কায়া গঠনের ক্ষেত্রে অর্থাৎ ভাববস্তুর ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা নিয়ে থাকে। এরই ফলে এক একটি ছড়া একাধিক খন্ড চিত্রের সমষ্টি হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সকলেই ছড়ার অন্তর্ভুক্ত এই খন্ড চিত্রের শোভাযাত্রা সমারোহের কথা বলেছেন। শুধুমাত্র অন্ত্যমিল এবং অন্যান্য মধ্যমিলকে অবলম্বন করেই ছড়ার কায়া নির্মিত হয় না। আরও নানা ভাবে সৃষ্ট হয়ে থাকে সেটি হল প্রশ্নোত্তর- মূলকতা। যেমন,
“পুটু নাচে কোন খানে? / শতদলের মাঝখানে / সেখানে পুটু কি করে?/ চুল ঝাড়ে আর ফুল পড়ে।”১০
মানবের কত নতুন পরিবর্তন হইয়াছে, কিন্তু শিশু শত-সহস্র বৎসর পূর্বে যেমন ছিল আজও তেমনি আছে, সে অপরিবর্তনীয় পুরাতন বারংবার মানবের ঘরে শিশু মূর্তি ধরিয়া জন্মগ্রহণ করিতেছে, অথচ সর্বপ্রথম দিন সে যেমন নবীন, যেমন সুকুমার, যেমন মুর এবং মধুর ছিল আজও ঠিক তেমনি আছে। এই নবীন চিরত্বের কারণ এই যে, শিশু প্রকৃতির সৃজন, কিন্তু বয়স্ক মানুষ বহুল পরিমাণে মানুষের নিজকৃত রচনা। তেমনি ছড়াগুলোও শিশু- সাহিত্য, তাহারা মানব মনে আপনি জন্মিয়াছে…।
কবি শিশু বলতে শুধুমাত্র শিশুকেই বোঝান নি, বয়স্ক মানুষের এক বিশেষ দিক কেউ তিনি নির্বাচন করেছেন। কবি তার নিজের শিশুসুলভ দৃষ্টিভঙ্গিতেই শিশুকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। শিশু বলতে আমরা আদিম মানব গোষ্ঠীর সারল্যকে বুঝি। এক দেশের শিশুর সঙ্গে যেমন আরেক দেশের শিশুর কোন অমিল নেই, তেমনি এক অংশের আদিম মানুষের সঙ্গে অপর অংশের আদিম মানুষেরও নিবিড় যোগ রয়েছে। সেই দিক থেকে শিশু ও আদিম মানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। শিশুর মত সরলতা ও জিজ্ঞাসু মন যাদের আছে, তাদের দ্বারাই মূলত ছড়া উদ্ভূত হয়েছে। ছড়ার মধ্যে রয়েছে বিশেষ এক ধরনের মনস্তত্ত্ব। যা সাধারণ শিশুর পক্ষে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়।
বিশেষ এক ধরনের মনস্তত্ত্ব।
যা সাধারণ শিশুর পক্ষে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়।
সমসাময়িক কালে ছড়া বিশেষ রচিত হয় না। ছড়া পূর্ববর্তী কাল থেকে চলে আসে তা সময়োপযোগী করে কিছু কিছু বাইরের দিক থেকে পরিবর্তিত করে নিতে হয়। এ পরিবর্তনেও অন্তর্ভুক্ত রস অব্যাহত থাকে। এই পরিবর্তনশীলতার প্রকৃতি বোঝাতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কামরূপধারিতা’ ও ‘কামচারিতা’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেছেন। এই শব্দ দুটির ‘কাম’ শব্দের অর্থ হলো ইচ্ছা। ব্যাপারটি ছড়ার মধ্যে কখনো প্রত্যক্ষ ও কখনও পরোক্ষভাবে কাজ করে। এ বিষয়টি তিনি বুঝিয়েছেন এভাবে, রূপান্তর বলতে আমরা বুঝি এক রূপ থেকে আরেক রূপে চলে যাওয়া বা অন্য আরেক রূপ ধারণ এবং সেটা ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছানুযায়ী। যেমন, ইন্দ্রের ইচ্ছে ছিল ঋষি পত্নী অহল্যার দেহসম্ভোগ করা কিন্তু অহল্যা ধর্মপরায়না সতী নারী। এমন ব্যভিচার সে প্রশ্রয় দেবে না। কাজেই ইন্দ্র অহল্যার পতী রূপ ধারণ করল। এই যে ইন্দ্র ইচ্ছা অনুযায়ী অন্যের রূপ ধারণ করল এটাই হল কামচারিতা বা কামরূপধারিতা। এই ধারণাটির সঙ্গে স্বাভাবিক রূপান্তরের বেশ একটা তফাৎ আছে। যেমন, ছিল ব্যাঙ্গাচি হয়ে গেল ব্যাঙ কিংবা ছিল শুয়োপোকা হয়ে গেল প্রজাপতি। এটি স্বাভাবিক রূপান্তর। শুয়োপোকা কখনো ব্যাঙ হতে পারবে না আবার ব্যাঙ কখনও প্রজাপতি হতে পারবেনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ভাবে স্থান কাল পাত্র বা পরিবেশ গত দিক দিয়ে ছড়ার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া অর্থাৎ রূপ পরিবর্তনের দিকটি বোঝাতে চেয়েছেন। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক
একটি ছড়া তে দেখা যায়- “খুকুমণির বিয়ে দেব হট্টমালার দেশে।
কিন্তু পূর্ব বাংলায় এক গ্রাম থেকে এরই একটি নতুন রূপ সংগ্রাহকদের হাতে এসেছে। সেখানে ছড়াটি হল- “নারগিসকে বিয়া দিব উজানতলির দেশে।
কাঠামোটি অবিকৃত রেখে স্থান ভেদে পছন্দসই কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। এতে রসের কোনো পরিবর্তন হয়নি। পরিবর্তন কেউ সচেতন ভাবে করে না, আপনি এটি পরিবর্তিত হয়। সেই জন্য কোন সচেতন মন যখন ছড়া পরিবর্তন করে প্রয়োজন সাধন করতে উদ্যোগী হয় তখন তাতে রস যেমন থাকে না তেমনি সৌন্দর্যও ফুটে ওঠে না। দেশান্তরে প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে শিশুর জন্য সামান্য পরিবর্তিত হয়ে যায় কিন্তু কোন ছড়া যে কখন কোথায় প্রথম উদ্ভূত হয়, তা নিরূপণ করা কঠিন।
অবশেষে বলা যেতে পারে, ছড়ার রচনাভঙ্গি গান-কথা-ধাঁধা-প্রবাদ-লোকনাট্যে যেমন ব্যবহৃত হয়েছে, তেমনি মধ্যযুগের নানা রচনাতেও তার প্রকাশ রয়েছে। এমনকি আধুনিক সাহিত্যেও ছড়াকে গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক প্রভৃতি দিক ব্যক্ত হয়ে ওঠে ছড়ার মাধ্যমে। পৃথিবীর যে কোন দেশে যে কোন বিষয় ছড়ার মাধ্যমে ব্যক্ত হয়ে থাকে। তাই সংকীর্ণ দৃষ্টিতে ছড়াকে লোকসাহিত্যের অঙ্গীভূত করা হলেও, ছড়ার ব্যাপকতার দিকটি অস্বীকার করা যায় না। বাঙালির জাতীয় জীবন, মানুষের রুচি, প্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষার জন্য ছড়ার ভূমিকা অপরিসীম।