রাজনীতির সংজ্ঞা
রাজনীতি একটি বহুমাত্রিক ধারণা, যা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে সম্পর্কিত। সাধারণত, রাজনীতি বলতে বোঝানো হয় ক্ষমতার অধিকার, ব্যবহার ও বিতরণকে কেন্দ্র করে পরিচালিত কর্মকাণ্ড। এটি ব্যক্তি, সমাজ, এবং রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
বিভিন্ন দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের মতে রাজনীতির সংজ্ঞা:
- অ্যারিস্টটল (Aristotle): অ্যারিস্টটল রাজনীতিকে একটি “নৈতিক বিজ্ঞান” হিসেবে অভিহিত করেন। তার মতে, “মানুষ একটি রাজনৈতিক জীব (Political Animal)” এবং সমাজে বাস করার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি থেকেই রাজনীতির উৎপত্তি হয়েছে।
- ডেভিড ইস্টন (David Easton): ইস্টনের মতে, রাজনীতি হলো সমাজে মূল্যবোধের প্রাধান্য স্থাপন ও বিতরণের প্রক্রিয়া।
- হ্যারল্ড ল্যাসওয়েল (Harold Lasswell): ল্যাসওয়েল রাজনীতির সংজ্ঞা দিয়েছেন, “কে, কী পায়, কখন পায় এবং কীভাবে পায়?”
সংক্ষেপে, রাজনীতি হলো সমাজে শাসনব্যবস্থার কাঠামো তৈরি, ক্ষমতার ব্যবহার এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি প্রক্রিয়া, যা নাগরিকদের মধ্যে শৃঙ্খলা ও কল্যাণ নিশ্চিত করে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি
রাষ্ট্রবিজ্ঞান হলো একটি সমাজবিজ্ঞান, যা রাষ্ট্র, সরকার, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও কার্যক্রমকে বিশ্লেষণ করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি সম্পর্কে মতবিরোধ থাকলেও এটি একটি স্বতন্ত্র ও শৃঙ্খলাবদ্ধ অধ্যয়ন হিসেবে গড়ে উঠেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতিকে প্রধানত তিনটি দিক থেকে ব্যাখ্যা করা যায়:
- রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি বিজ্ঞান:
- রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং তত্ত্বের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
- রাজনৈতিক ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণের জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
- তবে এটি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো সম্পূর্ণ নির্ভুল নয়, কারণ মানব আচরণ পরিবর্তনশীল।
- রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি শিল্প:
- রাষ্ট্র পরিচালনা এবং নীতিনির্ধারণ একটি দক্ষতা ও শিল্পের মতো।
- শাসকদের বিচক্ষণতা ও দক্ষতা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি নৈতিক বিজ্ঞান:
- অ্যারিস্টটলের মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য হলো মানুষের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করা।
- এটি ন্যায়বিচার, সাম্য, এবং স্বাধীনতার মতো মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি
রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি বিস্তৃত শৃঙ্খলা, যার পরিধি ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং সমাজের জটিলতার কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চর্চার ক্ষেত্র দিন দিন বেড়ে চলেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধিকে নিম্নোক্ত কয়েকটি শাখায় ভাগ করা যায়:
১. রাষ্ট্র ও সরকার বিষয়ক অধ্যয়ন
- রাষ্ট্রের উৎপত্তি, প্রকৃতি, উদ্দেশ্য এবং কার্যাবলি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল আলোচনার বিষয়।
- বিভিন্ন ধরণের সরকার, যেমন গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি বিশ্লেষণ করা হয়।
- রাষ্ট্রের অঙ্গসমূহ—বিচারবিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা—এদের ভূমিকা ও কাজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম আলোচ্য বিষয়।
২. রাজনৈতিক তত্ত্ব ও দর্শন
- রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো রাজনৈতিক তত্ত্ব ও চিন্তাধারা।
- প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হবস, লক, রুশো, মার্ক্স প্রভৃতি দার্শনিকদের রাজনৈতিক তত্ত্বগুলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল ভিত্তি তৈরি করেছে।
- ন্যায়, স্বাধীনতা, সাম্য, সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি ধারণার দার্শনিক বিশ্লেষণও এর অন্তর্ভুক্ত।
৩. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন
- রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যেমন:
i) সরকার
ii) রাজনৈতিক দল
iii) নির্বাচন ব্যবস্থা
iv) আমলাতন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে। - রাজনৈতিক দল এবং জনগণের অংশগ্রহণ কিভাবে সমাজে শাসনব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে, তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
৪. রাষ্ট্রের কার্যাবলি ও নীতি
- রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতি যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্পায়ন, অর্থনীতি এবং সামাজিক কল্যাণ নীতির কার্যাবলি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়।
- রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কও এর পরিধির মধ্যে পড়ে।
৫. রাষ্ট্র এবং নাগরিকদের সম্পর্ক
- রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নাগরিকদের অধিকার ও দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়।
- মৌলিক অধিকার, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং নাগরিকদের সমাজে ভূমিকা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা।
- সমাজে ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার বিষয়েও এটি আলোকপাত করে।
৬. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বৈশ্বিক রাজনীতি
- আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
- জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক আইন, যুদ্ধ ও শান্তি, বিশ্বব্যাপী সমস্যা (যেমন পরিবেশ, মানবাধিকার, অর্থনৈতিক বৈষম্য) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়।
৭. তুলনামূলক রাজনীতি
- বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামো এবং শাসনব্যবস্থার তুলনামূলক বিশ্লেষণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি অংশ।
- গণতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার তুলনা করে তাদের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা হয়।
উপসংহার
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি অত্যন্ত বিস্তৃত ও বহুমুখী। এটি শুধু রাষ্ট্র এবং সরকারের গঠন ও কার্যপ্রণালী নিয়ে আলোচনা করে না, বরং সমাজে মানুষের স্বাধীনতা, সাম্য, ন্যায়বিচার এবং কল্যাণ প্রতিষ্ঠার বিষয়েও আলোকপাত করে। আধুনিক বিশ্বের জটিল সমস্যাগুলো যেমন—পরিবেশগত সংকট, বৈশ্বিক উষ্ণতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ—রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষণা ও নীতিনির্ধারণের মাধ্যমে সমাধানের পথ দেখানো সম্ভব। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চর্চার মাধ্যমে একটি উন্নত, ন্যায়ভিত্তিক এবং গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন সম্ভব।