সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে একত্ববাদী তত্ত্ব:
সার্বভৌমিকতা (Sovereignty) হলো একটি রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব, যা কোনো বিদেশি শক্তির অধীনে না থেকে নিজস্ব ভূখণ্ডের উপর স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করা হয়। সার্বভৌমিকতার ধারণা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ক্ষমতার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, যার মাধ্যমে রাষ্ট্র নিজেকে শাসন করতে সক্ষম হয় এবং এর সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর অন্য কোনো দেশ বা শক্তির প্রভাব থাকতে পারে না। সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্ব (Monistic Theory of Sovereignty) এই ধারণাটিকে আরও পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করে, যেখানে সার্বভৌমিকতা একটি একক, অখণ্ড এবং অপরিবর্তনীয় ক্ষমতা হিসেবে দেখানো হয়।
একত্ববাদী তত্ত্বের মূল ধারণা
একত্ববাদী তত্ত্বের মূল ভিত্তি হলো যে, সার্বভৌমিকতা একটি একক সত্তা, বা একক শক্তি দ্বারা অধিকারিত এবং এটি বিভাজনযোগ্য নয়। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা কোনভাবেই বহুমুখী হতে পারে না। একমাত্র রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার বা শাসকগোষ্ঠী এই ক্ষমতার মালিক এবং তারা এককভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। সার্বভৌমিকতার কোন ভাগ বা বিভাজন এখানে গ্রহণযোগ্য নয়, অর্থাৎ রাষ্ট্রের সবকিছুতে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
একত্ববাদী তত্ত্বের ইতিহাস
একত্ববাদী তত্ত্বটি মূলত ১৬শ শতকের শেষে এবং ১৭শ শতকের শুরুর দিকে উদ্ভূত হয়। এই তত্ত্বের প্রবক্তা ছিলেন হোবস, বডিন, এবং সুইসিয়ানদের মতো দার্শনিকরা। তাদের মতে, রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা একমাত্র কেন্দ্রীকৃত সরকার বা রাজ্যের হাতে থাকতে হবে, যেটি সমাজের সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একক কর্তৃত্বপ্রাপ্ত। এই তত্ত্বের মতে, কোনো স্বাধীন ব্যক্তি, সংগঠন, বা অন্য কোন শক্তির রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অধিকার নেই।
একত্ববাদী তত্ত্বের মূল ধারণা:
একত্ববাদী তত্ত্বে পাঁচটি মূল দিক উল্লেখযোগ্য:
1. একক কর্তৃত্ব: সার্বভৌমিকতা একক, অবিভাজ্য এবং কেন্দ্রীভূত। রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী বা সরকারের হাতে এককভাবে এই ক্ষমতা থাকতে হবে। একাধিক সরকার বা শক্তির মধ্যে ক্ষমতার বিভাজন অনুমোদিত নয়।
2. অপরিবর্তনীয় ক্ষমতা: রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা কখনো কোনো বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ বাহিনীর কাছে হস্তান্তরিত হতে পারে না। একে কোনো বিশেষ পরিস্থিতি বা শর্তের অধীনে সীমিত করা যায় না।
3. প্রকৃত সার্বভৌমিকতা: একত্ববাদী তত্ত্ব অনুযায়ী, সার্বভৌমিকতা কোনো বিচ্ছিন্নভাবে কার্যকর হতে পারে না; এটি এককভাবে রাষ্ট্রের সমস্ত কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সকল বিষয় নির্ধারণে একক কর্তৃত্বের প্রাধান্য থাকবে।
4. নির্দিষ্ট স্থায়ীত্ব: একত্ববাদী তত্ত্বে বলা হয়, সার্বভৌমিকতা দীর্ঘস্থায়ী এবং অবিচ্ছিন্ন। এর কোনো নির্দিষ্ট সীমা বা মেয়াদ নেই, যা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে।
5. পরম ক্ষমতা: রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা পরম ক্ষমতার অধিকারী এবং একমাত্র সরকারই সমস্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য দায়ী। এই তত্ত্ব অনুসারে, কোনো পার্শ্ববর্তী শক্তি বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা ক্ষুণ্ণ করতে পারে না।
একত্ববাদী তত্ত্বের বিশ্লেষণ:
একত্ববাদী তত্ত্বের মূল দৃষ্টিভঙ্গি হলো যে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা তার নিজস্ব সীমার মধ্যে অবিচ্ছিন্নভাবে সংরক্ষিত থাকতে হবে। এটি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে সমস্ত সিদ্ধান্তের ক্ষমতা রাখে এবং কোনো বাহ্যিক শক্তি বা শাসনব্যবস্থা এই ক্ষমতার সাথে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। একত্ববাদী তত্ত্বটি একদিকে রাষ্ট্রের অখণ্ডতা নিশ্চিত করে, তবে অন্যদিকে এটি জনগণের অধিকার বা অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গোষ্ঠীর মতামতকে অগ্রাহ্য করতে পারে।
তবে এই তত্ত্বে কিছু সমালোচনাও রয়েছে। বিশেষত, এটি জনগণের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত অধিকারকে গুরুত্ব দেয় না এবং কখনো কখনো একক সরকারকে অত্যাচারী বা স্বেচ্ছাচারী হতে উৎসাহিত করতে পারে। একত্ববাদী তত্ত্বের মধ্যে রাষ্ট্রের একক কর্তৃত্বের ধারণা থাকলেও, এটি রাষ্ট্রের বাহ্যিক সম্পর্ক বা আন্তর্জাতিক আইনকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় না।
একত্ববাদী তত্ত্বের সুবিধা ও অসুবিধা
সুবিধা:
• নির্দিষ্ট শাসন: রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনো বিভাজন না থাকায় দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব।
• শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার: একক ক্ষমতা থাকায় রাষ্ট্র শক্তিশালী এবং কার্যকরভাবে শাসন পরিচালনা করতে সক্ষম।
• অস্তিত্ব রক্ষা: একত্ববাদী তত্ত্ব রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা অক্ষুণ্ণ রাখে এবং দেশকে অন্য শক্তি থেকে সুরক্ষিত রাখে।
অসুবিধা:
• জনগণের অধিকার হুমকির মুখে: জনগণের মতামত ও স্বাধীনতা এড়িয়ে চলে, যা গণতন্ত্রের মূল ধারণার বিপরীতে।
• শাসকের অপব্যবহার: একক ক্ষমতা সরকারের স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য উন্মুক্ত করে।
• আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা: অন্যান্য রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
উপসংহার
একত্ববাদী তত্ত্ব রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা ব্যাখ্যা করতে একটি শক্তিশালী এবং অখণ্ড দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। এটি রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে এককভাবে কেন্দ্রীভূত করে, যা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা এবং বাহ্যিক হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করে। তবে এটি সমসাময়িক রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করতে পারে এবং জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতার প্রশ্নে কিছু অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।