সেন আমলে কুলীনবাদের ওপর একটি টাকা লেখো। Write a note on Kulinism during the Sena Period.

সংস্কৃত শব্দ ‘কুনীন’ থেকে ‘কৌলিন্য’ শব্দের উৎপত্তি। কৌলিন্য প্রথা হল ‘হিন্দুকুল ও বর্ণ সমীকরণ আইন’, যা সেনরাজা বল্লাল সেনের দ্বারা 1158-1159-এর মধ্যে সেন সাম্রাজ্যে প্রবর্তিত হয়। সেন রাজাদের আমলে যে কৌলিন্য প্রথা শুরু হয়, তা আমরা জানতে পারি কুলজি গ্রন্থাবলি থেকে। কুলজি কাহিনি অনুসারে বল্লাল সেনের মাতামহ আদিশূর যজ্ঞানুষ্ঠানের জন্য উত্তর প্রদেশের কনৌজ থেকে পাঁচজন বেদবিদ ব্রাহ্মণ বাংলায় এনেছিলেন। এই ব্রাহ্মণদের সঙ্গে আসেন তাঁদের পাদুকা ও ছত্রবাহী পাঁচজন কায়স্থ ভৃত্য। পরে বল্লালসেন রাজা হয়ে ওই পাঁচজন ব্রাহ্মণ ও তাঁদের পাঁচজন ভৃত্যের চারজনের বংশধরদের আচার, বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, তীর্থদর্শন, নিষ্ঠা, বৃত্তি, তপস্যা এবং দান -এই ন-টি গুণের ভিত্তিতে ‘কুলীন’ রূপে গণ্য করেন। আর যেসব ব্রাহ্মণদের আটটি, সাতটি বা আরও কম গুণ ছিল তাঁরা যথাক্রমে সিদ্ধক্ষত্রিয়, সাধ্যক্ষত্রিয় এবং কষ্ট বা ‘কাষ্ঠ শ্রোত্রিয়’ নামে পরিচিত হলেন। কথিত আছে রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের 56টি গাঙ্গেয় মধ্যে বল্লাল সেন 19 জন ব্যক্তিকে কৌলিন্য প্রদান করেন। তবে এই কুলজী গ্রন্থের কাহিনি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সরকার অভিমত প্রকাশ করেছেন, বঙ্গীয় সমাজে কৌলিন্য প্রথা পূর্ব থেকে প্রচলিত ছিল, কিন্তু তা ভ্রমবশত বল্লাল সেনের ওপর আরোপিত হয়েছে।

কৌলিন্য প্রথায় বিশেষ করে হিন্দু সমাজকে রক্ষার স্বার্থে সমাজ গঠনের ওপর জোর দেওয়া হয়। বল্লাল সেন মূলত হিন্দু সমাজের ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থ-এই তিন শ্রেণির মধ্যেই কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তন করেন। কৌলিন্য প্রথার মূল উদ্দেশ্য ছিল-সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান বিষয়ে উচ্চ শ্রেণির (কুলীন) মধ্যে ন্যায়-নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা করা। বংশ কৌলিন্য, জাতিগত পবিত্রতা ও সততা রক্ষা করাই ছিল এদের মূল লক্ষ্য। বিশেষ করে ন-টি গুণসম্পন্ন মানুষরা হলেন শ্রেষ্ঠ কুলীন। বল্লাল সেন মনে করতেন, সভ্য জাতির সম্মান অত্যাবশকীয়। আর এই সম্মান লাভের জন্য সবাই সৎপথে চলবে। কুলীন মর্যাদা- বংশানুক্রমিক ছিল না এবং তিনি নিদান দেন-“প্রত্যেক ছত্রিশ বছর অন্তর কুলীনদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে।” গুণ ও কর্ম দ্বারাই ঠিক হত পরবর্তীকালে তারা কুলীন উপাধি ব্যবহারের কতখানি যোগ্য।

তবে কৌলিন্য প্রথার সঙ্গে বল্লাল সেনের নাম সংযুক্ত করতে নারাজ বর্তমান ঐতিহাসিকরা। অধ্যাপক অতুল সুর বলেন যে, একাদশ-দ্বাদশ নয় পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে বাঙালি কুলপঞ্জীকারগণ বংশগত পবিত্রতা রক্ষার জন্য কৌলিন্য প্রথা চালু করেন। আবার বল্লাল সেন রচিত ‘দানসাগর’-এ কৌলিন্য প্রথা নিয়ে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। আবার অনেকে বলেন বল্লাল সেনের অনেক আগেই থেকেই এই প্রথা প্রচলিত ছিল। তবে শুধুমাত্র তাঁর সময়ে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য এই প্রথা নতুনভাবে প্রচারিত হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading